বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক, অন্যায্য বলল দুদক

বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত ও অন্যায্য বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। গতকাল রবিবার বিকেলে দুদক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান এ মন্তব্য করেন।


দুদকের কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপপু ও আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক সে সময় উপস্থিত ছিলেন।
দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বব্যাংক 'আনস্যাটিসফায়েড রেসপনস'-এর যে অভিযোগ এনে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করেছে, একে সঠিক বলে মনে করে না দুর্নীতি দমন কমিশন। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের পরিধির মধ্য থেকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পরও কমিশনের আইনানুগ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ আছে বিশ্বব্যাংকের কাছে এমন দাবি প্রসঙ্গে দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, 'বিশ্বব্যাংক আমাদের কাছে এখনো কোনো প্রমাণ দেয়নি। অভিযোগ করেছে মাত্র।' তিনি বলেন, কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলেই তা প্রমাণিত হয়ে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী বা দালিলিক প্রমাণ। সে রকম কোনো দালিলিক প্রমাণপত্র বিশ্বব্যাংক দাখিল করতে পারেনি।
গোলাম রহমান বলেন, 'জুন মাসের ২৩-২৫ তারিখে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা ঢাকায় এসে দুর্নীতি দমন কমিশনকে যে তিনটি পরামর্শ দিয়েছেন, তা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দুদক আইনের পরিপন্থী ছিল বলে কমিশন সেগুলো গ্রহণ করতে পারেনি।' ঋণচুক্তি বাতিল বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনৈতিক, অবিবেচনাপ্রসূত ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করে এ অভিযোগের আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা হবে বলে জানান দুদকের চেয়ারম্যান।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ঋণচুক্তি বাতিল করে শুক্রবার একটি বিবৃতি দেয় বিশ্বব্যাংক। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে 'বিশ্বাসযোগ্য' দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলেও বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সংস্থাটি জানায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের অবহেলার কারণে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুদক এ বিষয়ে তদন্তকাজে কোনো ধরনের অবহেলা করেনি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিটি অভিযোগকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কমিশন রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করে না।
দুদক বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে রক্ষা করতে চাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক ক্ষুব্ধ হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দুদক কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিচার-বিবেচনা করে কাজ করে দুদক।
গোলাম রহমান বলেন, বিশ্বব্যাংক দাবি করেছে তাদের কাছে পদ্মা সেতুর বিষয়ে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। যদি সত্যিই এমন অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে তা বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করলে মানুষ প্রকৃত ঘটনা জানতে পারবে। বিশ্বব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করলেও এ বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশ ঋণ পেল কি পেল না তা দুদকের দেখার বিষয় নয়। দুদকের কাজ হচ্ছে উত্থাপিত অভিযোগ ও অপরাধীকে খুঁজে বের করা।
লিখিত বক্তব্যে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর মূল ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে কমিশনের ভিত্তিতে এজেন্ট নিয়োগের জন্য চাপ সৃষ্টির অভিযোগ করে। অর্থমন্ত্রীর কাছে অভিযোগের বিষয়ে চিঠি পাঠায়। চিঠির একটি অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া হয়। অভিযোগটি আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে খতিয়ে দেখা হয়, তবে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এর পর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ-সংক্রান্ত কথিত দুর্নীতির কিছু তথ্য বিশ্বব্যাংক দুদকের কাছে জমা দেয়। এতে বলা হয়, এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ সাহার নোটবইতে হাতে লেখা যে তালিকা পাওয়া গেছে, সে তালিকার সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সির তালিকার মিল রয়েছে। রমেশের তালিকার নামগুলো সাংকেতিকভাবে লেখা এবং তা থেকে নামের সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে দুদকের কাছে পাঠায় বিশ্বব্যাংক। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে দুর্নীতির সন্দেহ করে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক আর কোনো তথ্য দুদককে দেয়নি। বরং বিশ্বব্যাংক সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য দুদককে জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন একজন জ্যেষ্ঠ উপপরিচালকের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান টিম পুনর্গঠন করে। ওই টিম ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
একই বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, বিশ্বব্যাংক আগেই ঠিক করে রেখেছিল, পদ্মা সেতুর বিষয়ে বাংলাদেশকে ঋণ দেবে না। কারণ তারা যে ধরনের সহযোগিতা কমিশন থেকে চেয়েছে আইনের মধ্যে থেকে তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে দুদক। দুদকের গায়ে দোষ চাপিয়ে চুক্তি বাতিল করার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, আগে থেকেই বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। কারণ বিশ্বব্যাংক তাদের কাছে থাকা প্রমাণাদি দুদক চাওয়ার পরও দিতে পারবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়।

No comments

Powered by Blogger.