সমকালীন প্রসঙ্গ-আমাদের একাত্তর ও কাদির খানের প্রলাপ by সুভাষ সাহা

পাকিস্তানিরা এই ভাবনাটা কবে ভাবতে শিখবে যে, তারা ভারতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুললে উপমহাদেশ নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের বুকে একদিন পহেলা নম্বরের শক্তির স্থান দখল করে নিতে পারে, যার গর্বিত অংশীদার হবে তারাও। জনশক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক ও শক্তিসম্পদসহ অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে।


তাই ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে বন্ধু ভাবতে পারলে পাকিস্তানিদের মিথ্যা ঘোর থেকে মুক্তি মিলবে। অন্যথায় পাতালে প্রবেশ নিশ্চিত



পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার জনক ড. কাুিদর খান দীর্ঘদিন পর আবার মুখ খুলেছেন। আর তার মুখ খোলা মানেই তাতে চমক থাকবেই। এবার তিনি নিউজ উইক সাময়িকীর সর্বশেষ সংখ্যায় তার এক লেখায় বলেছেন, '৭১ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলে ভারত বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়াতে সাহস করত না আর বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানও ভেঙে যেত না। তার এই বক্তব্য পড়ে কারও মনে হতে পারে, বুড়ো লোকটা শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যায়নি তো! আমার কিন্তু তা মোটেই মনে হচ্ছে না। তবে আধুনিক যুগে নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসার পরও পাকিস্তানিদের কাছে নমস্য ব্যক্তিটি এখনও আধুনিকতা-পূর্ব ধারণা কী করে আঁকড়ে থাকতে পারেন, সে ব্যাপারে বিস্ময় সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে যারা খবরাখবর রাখেন তারা ড. খানের এহেন মন্তব্যে মোটেই অবাক হবেন না। তাদের কাছে তার এই বক্তব্য নিরেট পাকিস্তানিসুলভই মনে হবে।
পাকিস্তানিরা কোন যুদ্ধে জিতেছে বলুন? সর্বশেষ কারগিল যুদ্ধের ক্ষত তো তাদের ঢাকারও উপায় নেই। কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনী থেকে একজন সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত এ ব্যাপারে সামান্য লজ্জাবোধও নেই। বরং অধিকাংশ পাকিস্তানিই মনে করেন, যুদ্ধগুলোতে তারা বিজয়ী হয়েছেন। কেবল '৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়াকে তারা তাদের চরম পরাজয় বলে মনে করেন। কিন্তু এ জন্যও তাদের আত্ম-উপলব্ধি কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না। তা না হলে প্রকারান্তরে পারমাণবিক শক্তির ভয় দেখিয়ে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে ব্যর্থ করে দেওয়া যেত_ এমন একটা সন্ত্রাসী ভাবনার কথা ড. খানের মতো পাকিস্তানের বুদ্ধিদীপ্ত বিজ্ঞানীর মুখ দিযে বেরোয় কী করে!
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে একতরফাভাবে এহেন বস্তাপচা চিন্তাধারার জন্য দায়ী করা যাবে না। এর দায়ভাগ দেশটির বেসামরিক রাজনৈতিক নেতত্বেরও কোনো অংশে কম নয়। দেশটির এলিটরা সর্বতোভাবে এ ধারণাই পোষণ করতেন। যেহেতু ভারত পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে, তাই পরমাণু শক্তি অর্জনের মাধ্যমে ভারতের সমকক্ষ হতে হবে_ এমন একটি ভাবনা তাদের পেয়ে বসেছিল। জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতায় বসে সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তানিরা ঘাস খেয়ে থাকতে হলেও পারমাণবিক বোমা বানিয়েই ছাড়বে। তার আমলেই গোপনে পারমাণবিক বোমা তৈরির আয়োজন শুরু হয়। অথচ তখন সদ্য ভেঙে যাওয়া দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বতোভাবে নতুন ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তানি এলিটদের আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে নিজের জাতীয় পরিচয় সঠিকভাবে নির্ণয় করা উচিত ছিল। কেন বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ব্যাপকহারে ভোট দেওয়ার পরও তাদেরই সৃষ্ট রাষ্ট্রকে তারা অস্বীকার করল সে ব্যাপারটি গভীরভাবে পর্যালোচনা করা কি পাকিস্তানিদের উচিত ছিল না? শুধু তা-ই নয়, সামরিক হোক আর বেসামরিকই হোক_ যেসব পাকিস্তানি বাঙালি নিধন, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে একাত্তরের কালিমামুক্তির পথ করে নিতে পারত তারা। কিন্তু তারা তা করেনি। পাকিস্তানিরা একসময় নিজেদের আরব বা কেউ কেউ পারস্য থেকে আগত মুসলমান ভাবতেই গর্ববোধ করত। তারা যে এই উপমহাদেশেরই মানুষ, এই বোধটা পর্যন্ত তাদের মনোজগৎ থেকে তিরোহিত হয়েছিল। সে কারণে তারা বাঙালি মুসলমানদের খাটো করে দেখার অভ্যাস অনায়াসে রপ্ত করে নিতে পেরেছিল। এখনও পাকিস্তানি মানসিকতায় তেমন ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি বলেই এদেশে তাদের অপকর্মের দোসররা এখনও তাদের পরিত্রাণের জন্য পাকিস্তানের দিকেই তাকিয়ে থাকে। এবং এভাবেই এই একই শক্তি আমাদের দেশে পাকিস্তানি জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ড. কাদির খান পাকিস্তানের এবোটাবাদে মার্কিন হামলায় সন্ত্রাসবাদের শিরোমণি ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি মানেই দেশটির সুরক্ষার ক্ষেত্রে ব্রহ্মাস্ত্র এমন ধারণা ব্যক্ত করেছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন জঙ্গি হেলিকপ্টারের আকাশসীমা লঙ্ঘন বা সামরিক এলাকার মধ্যেই মার্কিন সিল ফোর্সের আক্রমণ চালিয়ে লাদেনকে খতম করার সময় কি দেশটির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়নি? পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রশক্তির ভয় কি মার্কিন সেনা অভিযানকে আটকে রাখতে পেরেছিল? পারেনি; বরং মোল্লা ওমর ও জাওয়াহিরিসহ অন্য তালেবান ও আল কায়দা নেতাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান নিজে থেকে ব্যবস্থা না নিলে একইভাবে তারা অভিযান পরিচালনা করবে বলে শাসিয়েছে। সুতরাং, পারমাণবিক শক্তি থাকলেই পাকিস্তানের ভয়ে ভারত বাঙালিদের স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হতে ভয় পেত বা বাঙালিরা এই ভয়ে পাঞ্জাবি-পাঠানদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে যেত না_ এমন ভাবনা পাকিস্তানিদের পক্ষেই সম্ভব। কাদির খানের মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগেনি যে, তখন তাদের না হয় পারমাণবিক বোমা ছিল না, কিন্তু তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের তো পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তারা কেন পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারল না? মার্কিন সপ্তম নৌবহরের আগমন সংবাদ শুনে কি আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ময়দান থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে ছিলাম, নাকি ভারত আমাদের সমর্থন করায় ক্ষান্ত দিয়েছিল?
হ্যাঁ, ড. কাদির খান ঠিকই ধরেছেন যে, ভারত এখন নিজেই পরাশক্তি হতে চায়। তার অর্থনীতি শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি করছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও তারা যথেষ্ট অগ্রসরমান। মহাকাশ প্রযুক্তিসহ নানা ক্ষেত্রেই তাদের উন্নতি যোগ চোখে পড়ার মতো। পাকিস্তান কি পারত না ভারতের মতো উন্নতির রাস্তায় চলতে? অবশ্যই পাকিস্তানের সামনে সে সম্ভাবনা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ছিল। কিন্তু তাদের এলিটরা উন্নয়নের রাস্তা না ধরে কেবল অস্ত্রশক্তি বৃদ্ধি করে ভারতকে সার্বক্ষণিক মোকাবেলার পথ গ্রহণ করার ফলে সে সম্ভাবনা তিরোহিত হয়। কেউ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দোস্তিই এমন সর্বনাশের কারণ বলবেন। কিন্তু দেশের সামরিক বাহিনী যদি নিজেদের রাষ্ট্রের ঊধর্ে্ব চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং একসময় ইসলামকে রাজনীতিতে চরমভাবে ব্যবহার ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে, তাহলে এর দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানো কেন!
ড. খান বলেছেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা না থাকলে হয়তো দেশটির অবস্থা ইরাক বা লিবিয়ার মতো হতে পারত। আমি বলব, যদি ভারতের নিকট প্রতিবেশী না হতো তাহলে পাকিস্তানের অবস্থা যে ইরাক বা লিবিয়ার মতো হতো না, তা কে বলতে পারে! তবে এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে এবং পাকিস্তান যদি তার ভারতবিরোধী নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি-কৌশল থেকে সরে না আসে, তাহলে ভারত একসময় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে মন্দের ভালো হিসেবে পাকিস্তানের আরেক দফা বিভক্তিকে মেনে নেবে। তাই পরমাণু বোমা থাকলেই সোভিয়েত সাম্রাজ্যের খান খান হওয়া যেমন ঠেকে না, তেমনি পাকিস্তানের প্রথমে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম ওঠা এবং পরে ভেঙে খান খান হওয়াও ঠেকবে না। ভাঙনের উপাদান পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই প্রকট। বালুচরা কি বিক্ষুব্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই করছে না? সিন্ধি আর মোহাজিররা কি ভাই ভাই হয়ে গেছে? মনে পড়ে, একসময় মুত্তাহিদা কওমি আন্দোলনের লন্ডন প্রবাসী নেতা আলতাফ হোসেন এই বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, মোহাজিরদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা না দিলে তারা ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে বাধ্য হবেন। পাহাড়ি এলাকার পশতুনরা কি আফগানিস্তানে তাদের সমগোত্রীয়দের সঙ্গে থাকতে চাইবে না? এর সঙ্গে পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি রাষ্ট্রের ম্যানুভারিং সামর্থ্যকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে এসেছে। এ অবস্থায় কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন যদি বিদেশি মদদ পায় তাহলে কি পাকিস্তানের সম্ভাব্য ভাঙন তাদের পারমাণবিক বোমা আছে বলে ঠেকবে? পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা মিয়া নওয়াজ শরিফ ঠিকই বলেছেন, ভারত প্রধান শত্রু_ এই ধারণাটা পাকিস্তানের পাল্টাতে হবে। আমি বলব, শুধু বৈরিতার ধারণা পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, পাকিস্তানকে এই নৈরাজ্য থেকে বের হয়ে আসার জন্য ভারতের হাত ধরে এগিয়ে যেতে হবে। পাকিস্তানিরা এই ভাবনাটা কবে ভাবতে শিখবে যে, তারা ভারতের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুললে উপমহাদেশ নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের বুকে একদিন পহেলা নম্বরের শক্তির স্থান দখল করে নিতে পারে, যার গর্বিত অংশীদার হবে তারাও। জনশক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রাকৃতিক ও শক্তিসম্পদসহ অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে। তাই ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে বন্ধু ভাবতে পারলে পাকিস্তানিদের মিথ্যা ঘোর থেকে মুক্তি মিলবে। অন্যথায় পাতালে প্রবেশ নিশ্চিত।
মার্কিন চাপে পড়ে এবং সামরিক বাহিনী ও আইএসআইকে বাঁচানোর তাগিদে ড. খান মোশাররফের শাসনামলে লিবিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ায় গোপনে পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তরের দায় স্বীকার করে মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া ও বিনা অনুমতিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন বাহিনীর সামরিক অভিযানের পর এবার তার পরমাণু বোমাকে পাকিস্তানের রক্ষাকবচ মনে করাটা বালখিল্য ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে!

সুভাষ সাহা :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.