সমুদ্রের বুকে সবুজ দ্বীপ by শম্পা ইফতেখার

নোনা সমুদ্রের বুকে ছোট একটা সবুজ দ্বীপ মহেশখালী। মহেশখালীতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এই বৈশাখের দ্বিতীয় দিনে। হোটেলে নাশতা সেরে সকাল সকাল রওনা দিলাম ঘাটের উদ্দেশে। প্রথমেই ভ্রান্তি_ গেলাম ৬ নম্বর ঘাটে, সেখানে কোনো ট্রলার নেই। তারপর জনপ্রতি ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে এলাম থানা ঘাটে।


সারি সারি মাছ ধরার সাম্পান আর অসংখ্য যাত্রীতে মুখরিত। কেউ মহেশখালীর বাসিন্দা, বাকিরা আমাদের মতো দর্শনার্থী। জমজমাট ট্রলার ব্যবসা চলে এখানে। দরদাম করে রিজার্ভ করলাম ট্রলার। বড় বড় ঢেউ ঠেলে খুব অল্প সময়ে ভিড়লাম মহেশখালীর ঘাটে। তবে সবাই আদিত্যনাথ মন্দির ঘাটে থামলেও আমরা নামলাম আগের ঘাটে। খালের ওপর বাঁধানো ঘাটপাড় রাস্তা। দু'পাশে সবুজ বনানী_ অকৃত্রিম, উদার প্রকৃতি। ঘাটপাড়ে সারি সারি রিকশা আর ব্যাটারিচালিত ট্যাক্সি। ড্রাইভারকে যথেষ্ট পোড়-খাওয়া বাস্তববাদী মনে হলো। মহেশখালী পুরোটা দেখানোর দায়িত্ব হাতে নিয়ে সে প্রথমেই নিয়ে গেল রাখাইনের বৌদ্ধ মন্দিরে। বৈশাখের রুক্ষতাও মনে হয় বুদ্ধের কাছে মাথানত করে আছে এখানে। বিশাল বুদ্ধমূর্তি_ বাইরে ছত্রদণ্ড-রাজারঘর সব মিলিয়ে দেখার মতো জায়গা। রাখাইন মহিলা আর পুরুষরা বৈসাবি উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আনুষ্ঠানিকতা পালন করছে। এ এক ভিন্ন রকম সংস্কৃতি। পাশেই রাখাইন বাড়িতে তাঁতে বোনা কাপড় কিনলাম, তাদের বুনন কৌশল দেখলাম। তারপর এলাম বিখ্যাত আদিত্যনাথ মন্দিরে। পাহাড়ের চূড়ায় রাধাকৃষ্ণ আর শিবের মন্দির। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা_ একপাশে শ্মশানঘাট আর বেশ কয়েকটা বটগাছ। মন্দিরে পুণ্যার্থীর ভিড়। হিন্দুশাস্ত্রে ১৫ এপ্রিল হলো পহেলা বৈশাখ। আর তাই হিন্দু রমণীরা মন্দিরে ভিড় করেছেন পুণ্য দিয়ে প্রথম দিন শুরু করার প্রত্যাশায়। গীতাপাঠ, নামকীর্তন_ সব মিলিয়ে ধর্মীয় আবহ। আমার সঙ্গীদের একাংশ পাহাড়ের এই পথের ক্লান্তিতে কাবু। কিন্তু আমরা কয়েকজন আরও ওপরের চূড়ায় উঠতেই বুঝলাম কী মাহাত্ম্য এই মন্দিরের। পুরো মহেশখালী হাতের মুঠোয়। চারদিকে সমুদ্রের সঙ্গে চোখে পড়ল পাহাড়ের ঢালে ফসলি জমি, নিচু ভূমিতে লবণ ক্ষেত, সারি সারি শুঁটকি শুকানোর ছোট ছোট ঘর। এই চূড়ায়ও গরুড়ের মূর্তি। উত্তাল নোনা বাতাস। সমুদ্রের ভয়াবহ তাণ্ডবে অনেকবারই মহেশখালীর কথা সংবাদে শুনেছি-পড়েছি। এত ভয়াবহতা আর বঞ্চনার মাঝেও বেঁচে থাকা এই মানুষগুলো নির্মম হয়নি প্রকৃতির বিরুদ্ধে। দখল করেনি পাহাড়। দরিদ্র এই মানুষগুলো পাহাড়ের মতো দৃঢ় আর আত্মপ্রত্যয়ী। চলে এলাম মন্দিরঘাটে, যা শুটিংঘাট নামে পরিচিত। ড্রাইভার জানাল, একদিন শুটিং হয়েছিল এই ঘাটে। এবার ফেরার পালা। ক্লান্ত আমাদের ব্যাগ তুলে দিলাম সমুদ্রের বুকে হারিয়ে যাওয়া এক মাছ শিকারির সন্তানের পিঠে। কী নির্মম বাস্তবতা। ঘাটে আসতেই চমকে গেলাম! পানি নেই_ কাদায় পূর্ণ একাকার। এর মধ্যে ট্রলারগুলো ঠেলে ঠেলে সামনের সমুদ্রে যাচ্ছে। বুঝলাম_ ভাটার সময়। বিদায় জানালাম মহেশখালীকে।

No comments

Powered by Blogger.