জননী সাহসিকার জীবনসাধনা by আয়শা খানম

মহীয়সী নারী কিংবা জননী সাহসিকা_ এভাবেই বেগম সুফিয়া কামাল এখন পরিচিত। ১০১ বছর আগে তিনি এক রক্ষণশীল জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন। চার দেয়ালের গণ্ডিঘেরা জীবনে পরিবারের সদস্যরা কথা বলত উর্দুতে। এমন পরিবেশে থেকেই তিনি বাংলায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেছেন, যুক্ত হয়েছেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে।


মা বলতে যে কারোরই মানসপটে ভেসে উঠবে যত্নশীল, মায়াবী ও সেবাপরায়ণ একটি মুখ। তিনি সবার কথা ভাববেন এবং নিজেকে অপরের জন্য উজাড় করে দেবেন। সুফিয়া কামাল এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার সন্তান এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা মমতাময়ী হিসেবেই তাকে পেয়েছেন। তবে আমাদের মতো অনেক নারী যারা নারী আন্দোলন, সাহিত্যকর্ম, সমাজসেবা কিংবা অন্য যে কোনো কারণে তার সংস্পর্শে এসেছেন তাদের কেউই এমন সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হননি। পরিবারের গণ্ডির মধ্যে থেকেই হয়ে উঠেছেন সবার প্রিয়জন। তিনি যথার্থই অনুপ্রেরণা, সংগ্রামের দিশা ও আলোকশিখা। তার জীবনসাধনা ছিল প্রতীকী হিসেবে কিছু নারী নয়, বরং সব নারীর জন্য সুন্দর জীবন প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি। এ জন্য বরফ গলাতে হয়েছে ও সে জন্য তিনি নিজে সাধ্যমতো সক্রিয় থেকেছেন এবং একই সঙ্গে অন্যদের সংগঠিত করায় ভূমিকা রেখেছেন।
সুফিয়া কামাল যে সময়ে পথচলা শুরু করেছেন, তখন অনেকটাই ছিল 'একলা চলরে...' অবস্থা। এখন কতই না পরিবর্তন। এ বছরেই নিশাত মজুমদার এবং ওয়াসফিয়া নাজরীন এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করা চার বাংলাদেশির মধ্যে দু'জনই নারী। গত দুই বছরে প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রী অষ্টম শ্রেণীর কোর্স শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রী সংখ্যা সমান। মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যাও প্রায় কাছাকাছি। উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রী সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিচ্ছেন নারী। গভীর রাতেও দেখছি টিভি ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরির জন্য দুর্গম ঘটনাস্থলে হাজির হচ্ছেন নারী সাংবাদিক। তারা সচিব এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে দক্ষতা দেখাচ্ছেন। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে এসেছেন। শুধু কুটির শিল্প নয়, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
'দুই নেত্রী' দেশে বহুল প্রচলিত। মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে রয়েছেন নারী। সংসদে সরাসরি ভোটে সংরক্ষিত নারী আসনের দাবি এখনও পূরণ হয়নি। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদে হাজার হাজার নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। সব স্থানে তাদের কাজের পরিবেশ মসৃণ নয়। আইন ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয় না। পদ্ধতিতেও সমস্যা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন জরিপ-সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, তৃণমূল পর্যায়ে নারী জনপ্রতিনিধিরা সততা, নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন এবং বর্ধিত দায়িত্ব গ্রহণেও তারা প্রস্তুত।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বরাবরই নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তৈরি পোশাক শিল্প নারীর সৃজনশীল শ্রমে শুধু বিকশিত হয়নি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশের জন্য গর্বের আসন এনে দিয়েছে। লাখ লাখ নারী গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে এসেছে আধুনিক শহরে। যে কৃষিতে বিপুল অর্জন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করছে, তার পেছনেও রয়েছে নারীর সক্রিয় অবদান।
এসব চিত্র আশাব্যঞ্জক এবং এ ক্ষেত্রে যে নতুন অবস্থান আমাদের তার প্রেক্ষাপট তৈরিতে বেগম সুফিয়া কামালের অবদান এখন মুক্ত কণ্ঠে স্বীকৃত হচ্ছে। তার নিরন্তর সাধনা ও সংগ্রাম আজ ফল দিতে শুরু করেছে। তবে এখনও যে অনেক পথচলা বাকি। এখনও প্রতিনিয়ত নারী লাঞ্ছিত হচ্ছেন। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বলি হচ্ছেন অনেক নারী। ফের চার দেয়ালে বন্দি করার জন্য যত্রতত্র দেওয়া হচ্ছে ফতোয়া। এ প্রতিকূলতা জয় করার জন্য চলছে সংগ্রাম ও তাতে প্রেরণা হয়ে আছেন এবং থাকবেন জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল। জন্মদিনে তার প্রতি জানাই
প্রণতি ও শ্রদ্ধার্ঘ্য।

আয়শা খানম :সভানেত্রী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
 

No comments

Powered by Blogger.