সময়চিত্র-প্রধানমন্ত্রী কী বলেন, কেন বলেন by আসিফ নজরুল

দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। ১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার রাতে বেগম খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি আমি। তিনি তখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেননি। বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে দুই নেত্রীর সাক্ষাৎকারও আমি নিয়েছিলাম, তবে তাও ১৫-২০ বছর আগে।


আমার সাংবাদিকতাজীবন শেষ হয়েছে মোটামুটি সেই সময়ে। এরপর বিভিন্ন উৎসবে দু্ই প্রধানমন্ত্রীর গণদাওয়াত পেয়েছি। যাওয়া হয়নি। গণদাওয়াতের যে ছবি দেখি টিভিতে, তাতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীরা কোনো কিছু কেন বলেন, তা আমার জানার উপায় নেই। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীরা অসীম ক্ষমতাধর। তাঁদের ধারেকাছের মানুষেরাও সেই ক্ষমতার স্পর্শ পেয়ে বদলে যান। তাঁদের গাম্ভীর্য বাড়ে, চেহারায় আরও বড়লোকি ভাব আসে এবং ব্যক্তিত্ব কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে চেনাজানা থাকলেও তাঁদের ধারেকাছে যাওয়ার সাহস আর থাকে না। কাছে যাওয়ার কারণও অবশ্য নেই আমার। কারণ থাকলে, তাঁদের ধারেকাছে গেলে আমি অবধারিতভাবে প্রধানমন্ত্রীদের বিষয়ে বহু প্রশ্ন করতাম তাঁদের। তাঁরা হয়তো তা পছন্দ করতেন না। কাজেই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে থেকেও প্রধানমন্ত্রীদের ভাবনাবিষয়ক জানার কোনো সুযোগ হলো না আমার।
কিন্তু তাতে আমার জানার তৃষ্ণা মেটে না। প্রধানমন্ত্রীদের কিছু কথা সত্যিই বুঝতে ইচ্ছে করে। গত আমলে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বা হাওয়া ভবনবিষয়ক বেগম খালেদা জিয়ার কিছু কথা বুঝতে পারতাম না। টক শোতে নিয়মিত যাওয়া হতো বলে অবাক হয়ে বলতাম, প্রধানমন্ত্রী কী করে এ কথা বললেন! এখন আমার বয়স কিছুটা বেড়েছে। অবাক হয়ে থেমে থাকি না। সত্যি সত্যি বোঝার চেষ্টা করি, প্রধানমন্ত্রীরা কেন কী কথা বলেন। এই চেষ্টা এখন তীব্র হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ কারণে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে নাটোরে বিএনপির একজন নেতার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, নাটোরের ঘটনা বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে ঘটেনি, তার কী প্রমাণ আছে! (প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর, ২০১০)
তিনি কি ভেবে দেখেছেন, তাঁর কথার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বিভিন্নভাবে?

২.
নাটোরে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে ৮ অক্টোবর। দিনদুপুরে জনবহুল এক স্থানে লাঠিসোঁটা দিয়ে সাপ মারার মতো পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা এবং একজন জনপ্রতিনিধি (উপজেলা চেয়ারম্যান) সানাউল্লাহ নূরকে। সেখানে সাংবাদিক ছিলেন, টিভি ক্যামেরাম্যান ছিলেন। কারা মেরেছে, কীভাবে মেরেছে, তার ভিডিও ফুটেজ আছে, স্থিরচিত্রও আছে। তার ভিত্তিতে পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগের নেতা জাকির হোসেনসহ দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান। ঘটনার এক দিন পর সানাউল্লাহর স্ত্রী নিজে নির্দিষ্টভাবে আওয়ামী লীগের নেতা জাকির হোসেনসহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন।
এরপর দেশে আরও কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জে ট্রেনের নিচে বিএনপির জনসভার মানুষ মারা গেলে উত্তেজিত লোকজন ট্রেনটি পুড়িয়ে দেয়, চালক ও গার্ডকে মারধর করে আহত করে। সিরাজগঞ্জের ঘটনায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। সিরাজগঞ্জ ঘটনার জের ধরে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী একপর্যায়ে নাটোর হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে মন্তব্যটি করে বসেন।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সংবেদনশীল একজন মানুষ। প্রায় ২০ বছর আগে তিনি রাস্তার শিশুদের নিয়ে ‘ওরা টোকাই কেন’ নামে একটি মর্মস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন শাহাদত চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তিনি দলের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষদের যেভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেন, যেভাবে তিনি এখনো তাঁর শিশু ভাইটির নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের কথা বলতে গিয়ে আবেগরুদ্ধ হয়ে ওঠেন, যেভাবে তিনি দুস্থ মানুষদের নানাভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করেন, বুকের ভেতর অতল স্নেহ-ভালোবাসা না থাকলে তা সম্ভব নয়। আমার প্রশ্ন সেখানেই।
এমন একজন ভালোবাসাময় মানুষ কি অনুভব করেন না সানাউল্লাহ নূর শুধু বিএনপির একজন নেতা ছিলেন না, তিনি রক্তমাংসের একজন মানুষ ছিলেন। তিনি একজন বাবা, একজন স্বামী এবং কারও সন্তান ছিলেন। তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে সামান্য সান্ত্বনাও পাবেন না তাঁর স্বজনেরা। তিনি তাহলে কী করে একটি তদন্তাধীন ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী হয়েও এমন মন্তব্য করেন? তিনি বাংলাদেশকে আমাদের চেয়ে অনেক ভালো চেনেন। তাঁর এই বক্তব্য চাকরি ও বদলির ভয়ে কম্পমান পুলিশকে প্রভাবিত করতে পারে। নাটোরের অপরাধীরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। তারা এবং পুলিশ মিলে এই বক্তব্যকে অপব্যবহার করে নাটোর হত্যাকাণ্ডকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল হিসেবে সাজানোর চেষ্টা করতে পারে। এই বক্তব্যের পর অন্তত পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে গড়িমসি করতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তা না বুঝতে পারার কথা নয়।
এসব আমার অতিশয়োক্তি নয়। সানাউল্লাহ নূরের স্ত্রী নিজে অভিযোগ করেছেন যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নাটোরের বনপাড়া বাজারে হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং পুলিশ তাদের ধরছে না। তিনি তাঁর নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছেন এ অবস্থায়। ২১ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে পাশাপাশি দুটি খবর। সিরাজগঞ্জের ট্রেন পোড়ানোর ঘটনায় এরই মধ্যে ৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ এর চার দিন আগে সংঘটিত নাটোরের ঘটনায় সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে মাত্র একজনকে। পুলিশ বলছে, আসামিদের পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এক দিন আগেই ২০ অক্টোবর ডেইলি স্টার প্রধান আসামি জাকির হোসেনের সাক্ষাৎকারের বিবরণ ছেপেছে। জাকির হোসেন বলেছেন, নাটোরের হত্যাকাণ্ড বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে হতে পারে। ৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে নাটোর হত্যাকাণ্ডে যে-ই জড়িত থাক, তার শাস্তিবিধান করা হবে। কয়েক দিন পর তিনিও ইঙ্গিত দিলেন, এ হত্যাকাণ্ডে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেও হতে পারে। আমরা হতবুদ্ধি! নাটোরের নেতাদের দ্বারা প্রধানমন্ত্রী প্রভাবিত হয়েছেন, নাকি তাঁর বক্তব্যে নাটোরের নেতারা দায়মুক্তির কৌশল খুঁজে নিয়েছেন।
নাটোরের সাংসদ আবদুল কুদ্দুসের বক্তব্য আরও চমকপ্রদ। রাস্তায় পড়ে থাকা সানাউল্লাহর সামনে লাঠি হাতে যে জাকির ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের ছবি ছাপা হয়েছে, তিনি বলছেন তাঁরা নাকি সানাউল্লাহকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন!
২০ অক্টোবর প্রতিবেদনে ডেইলি স্টার প্রশ্ন করেছিল: তাহলে সানাউল্লাহকে কারা হত্যা করেছে?
আবদুল কুদ্দুসের উত্তর: আমি এটা বলতে পারব না, কারণ এটি এখন তদন্তাধীন।
ডেইলি স্টার: আপনি তাহলে কীভাবে বলেন ক্ষমতাসীন দল এর সঙ্গে জড়িত না, এটি কি তদন্তকে প্রভাবিত করবে না?
তিনি এর উত্তরে নীরব থাকেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার বেয়াদবি হলে মাফ করবেন। নাটোরের ঘটনায় আপনার মন্তব্য এর তদন্তকে আরও বেশি প্রভাবিত করতে পারে। হতে পারে আপনি আসলে কথার কথা হিসেবে এটি বলেছেন। হতে পারে আপনি নিজে হয়তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করতেও বলেছেন। কিন্তু নাটোরের ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আপনার প্রকাশ্য মন্তব্যই বহু মানুষের বুকে কাঁটার মতো বিঁধবে।
নাটোরে গামা হত্যা মামলায় আদালতে শাস্তিপ্রাপ্তদের ঢালাওভাবে ক্ষমা করেছে এই সরকার। নাটোরেই সানাউল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়টিও মানুষের ভোলার কথা নয়।

৩.
আমরা জানি, গত সরকারের আমলে নাটোরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জাকির হোসেনের বাবা নিজেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এসবের বিচার করার মতো সুযোগ ও ক্ষমতা এই সরকারের রয়েছে। তা না করে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অতীতের হত্যাকাণ্ডকে তুলনায় নিয়ে আসা মানেই হচ্ছে বর্তমান হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া, এর তদন্তকে প্রভাবিত করা, আরও সহিংসতার জন্য নিজ দলকে অনুপ্রাণিত করা। এই কাজটিও আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা করছেন। এতে আর যা-ই হোক, দেশে আইনের শাসন থাকে না, সরকারের নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় থাকে না, সাধারণ মানুষের মনেও কোনো স্বস্তি থাকে না।
আমাদের সরকারগুলো এসব স্মরণে রাখে না। তাদের অন্যতম ব্যর্থতা হচ্ছে, তারা ভুলে যায় তারা দলের সরকার নয়, দেশের সরকার। দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা ও সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সাংবিধানিক শপথ গ্রহণ করে তারা ক্ষমতাসীন হয়। ক্ষমতায় এসে তাই কোনো খুনকে সামান্যতম পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করার কোনো অধিকার তাদের নেই। এ কথা প্রতিটি সরকারের আমলে আমরা বলি, লিখি। প্রতিটি সরকারের আমলে তারপরও একই ঘটনা ঘটতে থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তবু আপনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা একটু বেশি। আপনজনের বিয়োগব্যথা আপনার চেয়ে বেশি কেউ আর অনুভব করেনি বাংলাদেশে। হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার মনস্তাপ আপনার চেয়ে সুদীর্ঘ সময় আর কেউ বহন করেনি এ দেশে। সানাউল্লাহ নূরের স্ত্রী ও সন্তানদের সমব্যথী আপনি যদি না হতে পারেন, তাহলে স্বজনহারা মানুষ কোন সান্ত্বনা নিয়ে বাঁচবে! আপনার কোনো বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেও যদি তদন্তকে প্রভাবিত করা হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে বিচার পাবে?
আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, সানাউল্লাহ নূরের স্ত্রী শেষ পর্যন্ত আপনার কাছেই অনুরোধ করেছেন এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার জন্য। আপনি যদি তাঁকে কাছে ডেকে নিয়ে বিচারের আশ্বাস দেন, তাহলেই তা আপনার ভালোবাসাময় হূদয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। আপনাকে শুধু দলের নয়, দেশের নেতা মনে হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.