দুর্নীতির অনুপ্রাস by শাহেদ মুহাম্মদ আলী

আমার অনুপ্রাস-অনুরাগ আছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে এবার বাংলাদেশের অবস্থান দ্বাদশ। এর মধ্যেও অনুপ্রাসের অন্তটান অনুভব করি। ‘বাংলাদেশ দ্বাদশ’—পুলকিত হই অনুপ্রাস তৈরি করে। কিন্তু আগামী বছর বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে? কোনো অনুপ্রাসের জন্ম হবে তো! যদি এগিয়ে ১৮তম মানে অষ্টাদশ স্থানের মধ্যে যেকোনো অঙ্কে অবতরণ করতে পারে বাংলাদেশ, তা হবে মহাখুশির খবর।


কারণ অনুপ্রাস হবে। যেমন—বাংলাদেশ ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ ইত্যাদি। আর যদি পিছিয়ে যায়? বাংলাদেশ একাদশ—অনুপ্রাস হয়। কিন্তু তার নিচে নামলে? কাব্য হয়—দশের চক্রে বাংলাদেশ। তবে দশ চক্রে ভগবান ভূত বলা যাবে না। ভূত অথবা ভগবান—যে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ এত নিচে নামবে কি না? এই দুশ্চিন্তা দূর করতে পারে ধারণা সূচক তৈরির ভিত্তি। এখানেও বিষয় দশটা। দুর্নীতি ও ঘুষের আদান-প্রদান, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও তহবিল অপসারণ, দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ ও অর্জনে বাধা দান, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার, প্রশাসন, কর আদায় ও বিচার বিভাগের কাজে বিধিবহির্ভূত অর্থ আদায় এবং সর্বোপরি এ ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে ও দুর্নীতি সংঘটনকারীর বিচার করতে সরকারের সামর্থ্য, সাফল্য ও ব্যর্থতা। এই দশ বিষয়ের প্রতি নজর রাখলে আপনিও বলতে পারবেন, আগামী বছর কী ফলাফল হতে যাচ্ছে।
তবে এর সঙ্গে আরও যোগ করতে হবে—সরকার দুর্নীতিবিরোধী কথা বলছে, না দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে? জাতীয় সংসদ হ্যাঁ-হ্যাঁ, না-না করছে, না কার্যকরভাবে চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনতার কথা বলছে, না স্বাধীনভাবে কাজ করছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত কথামালা বলছে, না সময়মতো নির্বাচন করছে। তথ্য কমিশন অধিকার আইন মেনে তথ্য সরবরাহ করছে, না আইনের ফাঁক দেখাচ্ছে। বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার করছে, না তাদের বিচারের জন্য সালিস বসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাকে রক্ষা করছে, সরকারি প্রশাসন কাকে শাসন করছে? মানবাধিকার কমিশন নিজের অধিকার নিয়ে আর্তনাদ করছে, না মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। বাবাজিরা চাঁদাবাজি কেমন করছে? কালো টাকা টাকা থাকছে, না ডলার-পাউন্ডে বদলে যাচ্ছে।
আসলে দুর্নীতির জন্য চাই পরিবেশ। অস্থির পরিবেশে দুর্নীতির চারা গজায় ভালো। আফগানিস্তান ও ইরাকে এবার দুর্নীতির বাম্পার ফলন হয়েছে। ‘টাকা দাও, তালেবান মারি’ করে করে আফগানরা আর ‘সৈন্য দাও গণতন্ত্র আনি’ করে করে ইরাকিরা দুর্নীতিকে সবার ওপরে হাজির করেছে।
বছর পেরিয়ে আমাদের দেশেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। বখাটেদের অস্থিরতা, ছাত্রলীগের অস্থিরতা, যুবলীগের অস্থিরতা, ফাঁকে ফাঁকে ছাত্রদল-শিবিরের অস্থিরতা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস নিয়ে অস্থিরতা, জমি নিয়ে অস্থিরতা, প্লট-ফ্ল্যাট নিয়ে অস্থিরতা, খাল দখল নিয়ে অস্থিরতা, খাল উদ্ধার নিয়ে অস্থিরতা। আরও আছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গালবাজি, চালবাজি, মালবাজি। আমাদের স্লোগান হয়ে পড়ছে—মারি-কাটি উন্নতি করি। আগামী বছরে আমরা এর ফল পাব বলে আশা করি।
প্রথম বছরে কেন ফল পাইনি? অনভিজ্ঞতার জন্য। আমাদের সবাই আনকোরা নতুন, অনভিজ্ঞ। এই নিয়ে সরকারকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। একজনের তো বয়স ঘোষণা করে বলতে হয়েছে, তিনি তরুণ না, প্রবীণ। কিন্তু গত দেড় বছরে তাঁরা অনেক অভিজ্ঞ হয়েছেন। ফাঁক-ফোকর চিনেছেন। মারপ্যাঁচ বুঝেছেন। আড়ষ্ট আমলারা আড়মোড়া ভেঙে উঠেছেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি হয়েছে। তহবিল তৈরি হয়েছে। টাকা ছাড় হয়েছে। দরপত্র হচ্ছে। দরপত্র ছিনতাই হচ্ছে। তা ঠেকাতে বিভিন্ন স্থানে ‘নেগো কমিটি’ (নেগোসিয়েশন) হচ্ছে। এখন ‘কাজ’ শুরু হবে।
একটা গল্প বলি। গত বছরের ঘটনা। জেলায় একটি কারিগরি কলেজ হবে। ঢাকা থেকে জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে, জায়গা নির্বাচন করে দিতে। তারা জায়গা নির্বাচন করার উদ্যোগ নিয়েছে। খোঁজ-খবর হচ্ছে। কিন্তু ঢাকা তাড়া দিচ্ছে। সঙ্গে পথও বাতলে দিয়েছে। অমুক গ্রামে যাও, সেখানে জমি আছে। প্রশাসন ইশারা বোঝে। তারা জায়গা পরিদর্শনে গেছে। ৩০ কিলোমিটার দূরে, প্রধান সড়ক থেকে ভেতরে রাস্তা-ঘাট নেই বললেই চলে। যাতায়াতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এখানে কলেজ হবে কি, উন্নয়নকাজের জিনিসপত্র-যন্ত্রপাতিই তো আনা যাবে না। জায়গার বিষয়ে জনপ্রতিনিধির সুপারিশ লাগবে। আশা উঁকি মারছে। প্রতিনিধি একেবারে আনকোরা, এবারই প্রথম নির্বাচিত হয়েছেন। কোনো দাগ নেই। জায়গার অবস্থা জানালে নিশ্চয় বুঝবেন। জানানো হলো। বললেন, বাদ। অন্য জায়গা দেখেন। সে হিসেবে কাজ শুরু হলো।
একদিন জননেতার বাড়ি থেকে ডাক এল। অগ্রগতি কী? জানানো হলো। হ্যাঁ! ওই জায়গায় সমস্যা কী? চলেন গিয়ে দেখি? হঠাৎ উল্টো রথ! পথের পাঠশালায় কিছু চরিত্র স্পষ্ট হলো। অনেক কিছু জানা গেল। জননেতা জমি পর্যন্ত পৌঁছালেন। কপাল কুঁচকানো, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। স্থানীয় আগ্রহীদের প্রকাশ্যে বকাঝকা করে বসলেন। তাঁরা বিস্মিত। এ কী! ইশারা বোঝে না, মফিজ নাকি! বুঝলাম নতুন, কিন্তু এই দেশেরই তো মানুষ। রেগে-মেগে নেতা ফিরলেন শহরে।
স্থানীয় কর্তাদের আশা, যাক বাঁচা গেল। ধমক খাওয়ারা জেলা অফিসে ঘোরাঘুরি শুরু করল। বাতাসে অঙ্কের আঁকিবুকি। সবাই তাঁদের চেনে। আগেরবারের অন্য দলের সাংসদের ডান হাত ছিলেন। দেশ দুর্নীতিতে কয়েকবার ১ নম্বর হওয়ায় তাঁরও যৎসামান্য অবদান ছিল। ছোট কর্তারা প্রমাদ গুনলেন। বড় কর্তা চুপ। অভিজ্ঞ মানুষ।
কিছুদিন পর আবার ডাক পড়ল নেতার বাড়ি। ওরা তো ঢাকা থেকে সব ঠিক করে আনবে। আমাদের সমস্যা কী? ওই অবকাঠামোয় নির্ধারিত তহবিলে কলেজ করা সম্ভব না। নেতা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, যতটুকু হয় হোক। বাকিটা কাবিখা-টিআর থেকে করিয়ে নিতে হবে। কর্তারা সজাগ হলেন, নেতা তো শিখছেন, দ্রুতই শিখছেন। আশার কথা!
রাস্তা তো নেই, তার কী হবে? শিক্ষার্থীরা যাবে কীভাবে?
নেতা বললেন, রাস্তার জন্য আলাদা তহবিল জোগাড় করতে হবে। কর্তার কপালে ভাঁজ, ঠোঁটে হাসি, মন্দ না, প্রকল্প বাড়ছে। টাকা আসছে। চেনা ছাঁচ।
দ্রুত ছাঁচে ফিরছে সবাই। ফল আমরা পাবই।

No comments

Powered by Blogger.