ফুলবাড়ী-উন্মুক্ত কয়লাখনি ও মানুষের নিরাপত্তা by নাসরিন সিরাজ

বাংলাদেশে ‘বিদ্যুৎসংকট’ মোকাবিলায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকে সমর্থন করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে আলোচনা চলছে, সেখানে ফুলবাড়ীর স্থানীয় মানুষের বক্তব্য শোনার প্রয়োজনীয়তা আছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে এখনো পর্যন্ত যে বিতর্ক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, সেখানে অর্থনীতিবিদ, খনিজ সম্পদ


বিশেষজ্ঞদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। এই বিতর্কে নৃবিজ্ঞানীদের সংযুক্ত হওয়ার ওপর গুরুত্ব বিবেচনা করে আমি বলতে চাই যে মানুষের নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই বিতর্কে যথেষ্ট মনোযোগ পাচ্ছে না। অথচ মানুষ আর মানুষের নিরাপত্তাই হওয়া উচিত যেকোনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
এই লেখার ভিত্তি ২০০৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে আগস্ট ২০১০ সময়ের মধ্যে করা একটি নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজi। এই গবেষণায় আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি, কীভাবে উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রতিষ্ঠাবিরোধী সামাজিক আন্দোলন সফলতা লাভ করেছে (যেমন, ২০০৬ সালের আগস্টের শেষে উন্মুক্ত কয়লাখনি না করার পক্ষে সরকারের মুচলেকা) এবং কীভাবে আন্দোলনটি অব্যাহত আছে। গবেষণাকাজের জন্য জাতিতাত্ত্বিক (অ্যাথনোগ্রাফিক) তথ্য সংগ্রহ করতে আমি টানা তিন মাস ফুলবাড়ীতে বসবাস করেছি এবং স্থানীয় আন্দোলনকারীদের দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছি।
আমার গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথমত, ফুলবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হতে হবে—এ রকম একটি পরিস্থিতি ফুলবাড়ীবাসীকে ব্যাপকহারে এই আন্দোলনে যোগদানে অনুপ্রাণিত করেছে। নৃবিজ্ঞানী ম্যাকডোনাল্ডের মতে, ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা অনেক সময় সামাজিক আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটাতে পারে। তাঁর মতে, এ ধরনের আন্দোলন জোটবদ্ধ হওয়ার জন্য পরিচয়ের একতা দরকার নাও হতে পারে। বরং পরিস্থিতি আন্দোলনকারীদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় বিলীন করে দিতে পারে এবং ভিন্নতাসহ একতা তৈরি করতে পারে। ফুলবাড়ী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যে এর সদস্যরা সবাই এক পরিচয়ের নয়। এখানে কেউ বামপন্থী, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ পা ফাটা (দিনমজুরের স্থানীয় টার্ম), কেউ কৃষক-শ্রমিক-খেতমজুর, কেউ বাঙালি, কেউ আদিবাসী, কেউ পুরুষ, কেউ নারী। তদুপরি, ‘জীবন দিয়ে হলেও খনি ঠেকাতে হবে’ এ লক্ষ্যে তারা নিজেদের ভিন্নতাসহ একজোট হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আন্দোলনে যোগদানের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিরাপত্তার ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নৃবিজ্ঞানীদের (যেমন, এসকোবার, রুবিন, সালমান ও অসিস) মতে, আন্দোলন সংগঠনকে বুঝতে মানুষের নিজস্ব ভাবনা ও সংস্কৃতি বিবেচনা করতে হবে। নিরাপত্তা নিয়ে সব মানুষের ভাবনা এক রকম নয়, তারা একেক সময় একেক পরিবেশে নিরাপত্তা নিয়ে নানা রকম চিন্তাভাবনা করে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখায় (এরিকসেন, বাল, সালেমিন্ক, ২০১০)। সংস্কৃতি যেমন নিরাপত্তার স্থানিক অর্থ তৈরি করে (গিডেন্স ২০০০, বোহল্ম ২০০৩), তেমনি নিরাপত্তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ঝুঁকি নিয়ে আন্দাজ ও ঝুঁকি নেওয়া বা না নেওয়ার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে (সালমান, ২০১০)। ফুলবাড়ীতে দেখা গেছে, উন্মুক্ত খনি প্রতিষ্ঠাবিরোধী আন্দোলনে যোগ না দেওয়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে স্থানীয় ব্যক্তিদের। এই মনে হওয়ায় কাজ করেছে উচ্ছেদের ফলে ‘নিরাপদ সামাজিকতা’ (টমাস এইচ এরিকসেন, ২০০৫) হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এরিকসেনের মতে, নিরাপদ সামাজিকতার মধ্যে মানুষ উষ্ণতা ও আরাম বোধ করে আবার নিজ সম্প্র্রদায়ের বাইরে মানুষদের শীতলতা তাদের এই নিরাপত্তাবোধের ধারণাকে শক্তিশালী করে। ফুলবাড়ীতেও মানুষ আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সচ্ছল কৃষি, আরামের বসতবাড়ি নিয়ে নিরাপদ সামাজিকতা তৈরি করেছে। তবে অনেক আন্দোলনকারীই উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রতিষ্ঠাবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে শুধু এই নিরাপত্তা রক্ষা করতে নয়, তাদের সম্পদের (যেমন, জমি, কর্মসংস্থান) অভাব ও সীমিত প্রবেশাধিকার এবং নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাহীনতার হাত থেকে বাঁচার জন্যও। দেখা গেছে যে দেশ থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা (যেমন, ১৯৪৭-এর ভারত-পাকিস্তান বিভাগ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে), সহিংসতার (যেমন, গৃহস্থালীয়, রাষ্ট্রীয় এবং সাম্প্র্রদায়িক) শিকার হওয়ার এবং বাদ পড়ে যাওয়ার (যেমন—রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নীতি তৈরি ও সরকারি সেবা থেকে) পূর্ব অভিজ্ঞতা আন্দোলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তৃতীয়ত, উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রতিষ্ঠাবিরোধী আন্দোলনে ফুলবাড়ীতে নারীদের জোটবদ্ধ হওয়া লিঙ্গীয় শ্রম বিভাজন ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসর বিভাজন দ্বারা নির্দিষ্ট ছিল। এই আন্দোলনে তারা তাদের নিজেদের মতো করে মানব নিরাপত্তার ধারণা বুঝেছে, মূল্যায়ন করেছে এবং প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যেটা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের চেয়ে ভিন্ন রকমের ছিল। খনিবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নারীদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং যে নতুন নতুন যোগাযোগ তৈরি হয়েছে, সেটা তাদের আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে নিজস্ব উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এরিকসেনের (২০০৬) মতে, আজকাল বিশ্বে ধনী অংশের মধ্যে মানুষের কথা না শোনার দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। আর সেই বাস্তবতা উন্মুক্ত খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের নীতিনির্ধারণেও দৃশ্যমান। তাই এখানে অনেক আলাপই হয় কিন্তু উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রতিষ্ঠার কারণে উচ্ছেদ-শঙ্কায় থাকা প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ও তাদের জীবনের নিরাপত্তার আলাপ হয় না। এর মধ্যে আবার সংখ্যায় যারা বেশি, অর্থাৎ যারা অল্প জোতের অধিকারী কৃষক (ছয়-আট বিঘা কৃষি জমি), খেতমজুর ও দিনমজুর (দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি, কিন্তু অনিয়মিত কর্মসংস্থান) তাদের কথা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা কখনোই শোনে না বলে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ। এই লেখার উদ্দেশ্য এই নয় যে আমি নিজেকে ফুলবাড়ী বিশেষজ্ঞ দাবি করছি অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ‘স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কনসাল্ট করা হোক’ এটা নিয়ে ওকালতি করছি।
দেখা গেছে যে ফুলবাড়ীবাসী শ্রেণী, পেশা, লিঙ্গ, ভাষা, এথনিসিটির বিভিন্নতায় বৈচিত্র্যময়। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন জীবনযাপন আছে। এ সবকিছু উপেক্ষা করে উন্মুক্ত খনি প্রতিষ্ঠার যেকোনো তৎপরতা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুরসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে ধ্বংস ডেকে আনবে।
উল্লেখ্য, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কিছু দাবি তুলছে। কিন্তু তাদের কথাই উন্মুক্ত কয়লাখনিবিরোধীদের শেষ কথা নয়। আন্দোলনের বিভিন্ন পরতে পরতে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দাবিতে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। সেগুলো উপেক্ষা করা অগণতান্ত্রিকও হবে বটে।
(M‡elYvwU Kiv n‡q‡Q gv÷vm© QvÎx wn‡m‡e, Avg÷viWv‡gi wåR BDwbfvwm©wUi b„weÁvb wefvM †_‡K| gvVKg© mgq : Rvbyqvwi 2010-gvP© 2010)
নাসরিন সিরাজ: নৃবিজ্ঞানী
nasrinsiraj@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.