ধর্ম-প্রতিশ্রুতি পালনের নির্দেশনা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা প্রশংসনীয় আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরবি ‘আহ্দ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় কোনো লোকের সঙ্গে অপর কোনো ব্যক্তি অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা পালন করার নাম ওয়াদা।


জীবন চলার পথে প্রতিনিয়ত মানুষকে যেসব প্রতিশ্রুতি করতে হয়, সেগুলো পূরণের ব্যাপারে ইসলাম জোরালো তাগিদ দিয়েছে। এ ব্যাপারে সামান্যতম শৈথিল্য প্রদর্শন মানবসমাজে মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ জন্য পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-৩৪)
ওয়াদা পালন করা আল্লাহর নির্দেশ। মানুষকে অবশ্যই আল্লাহর সঙ্গে তার চুক্তির বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে এবং ওই চুক্তির সত্যিকার বৈশিষ্ট্য-সম্পর্কিত সত্য জানতে হবে। যেন মানুষ তার চুক্তি ভঙ্গ না করে, তার শক্তিকে অপব্যবহার না করে, তার সত্যিকার প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত না হয় এবং এভাবে নিজে ন্যায়বিচারের পথ থেকে সরে না আসে। যে ওয়াদা পালন করে না তার ঈমান অর্থহীন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না, তার ধর্মই নেই।’
ইসলামি জীবনদর্শনে ওয়াদা পালন করা প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে না, সে মুমিন থাকে না। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা মুনাফিকের স্বভাব। তাই শরিয়তের বিধানমতে, প্রতিশ্রুতিদানের পর যদি এমন কোনো বাধা চলে আসে, যার ফলে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে যাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তাকে নিজের অপারগতা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। মুনাফিকের স্বরূপ উন্মোচন করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি: যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন যে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি পূরণ করা তাকওয়া তথা খোদাভীতির পর্যায়ভুক্ত। ওয়াদা পালন করা তাকওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম মানুষকে যেসব উন্নত চরিত্রের শিক্ষা দেয়, তন্মধ্যে একটি মৌলিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অঙ্গীকার। অঙ্গীকার পূরণ করার ক্ষমতা থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালনে শরিয়তের কোনো আপত্তি না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা পূরণ করা ওয়াজিব। পবিত্র কোরআনে ওয়াদার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করবে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-১)
অঙ্গীকার বা চুক্তি রক্ষার সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াদা পালন সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার পূর্বশর্ত। পৃথিবীতে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। সামাজিক প্রয়োজনেই মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সময় ওয়াদা করতে হয়। কেননা, চুক্তি না করলে সমাজে বহু রকমের অঘটন ঘটে থাকে, তখন সমাজে বসবাস করা কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। চুক্তি মোতাবেক কাজ করা ঈমানের একটি অপরিহার্য বিষয়। চুক্তি বা অঙ্গীকার সঠিকভাবে পালন না করলে সমাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে এবং অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। মানুষ যদি তাদের সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে প্রদত্ত ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন না করে, তবে ওই সমাজ বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। ওয়াদা ভঙ্গকারী সমাজজীবনে বিশৃঙ্খলা অবধারিত। যারা ওয়াদা পালন করে না বা কথা দিয়ে কথা রাখে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা যা করো না তা তোমরা কেন বলো?’ (সূরা আস-সাফ, আয়াত-২)
রাষ্ট্রীয় জীবনে শাসকদের ওয়াদা পালন দেশ ও জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। জনগণের প্রতিনিধি শাসকেরা আপামর জনতাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ঠিকমতো পালন করে না বলেই সর্বত্র নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অশান্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করে থাকে। ওয়াদা এক প্রকার ঋণ। কারও কাছ থেকে কোনো কিছু ঋণ নিলে তা যেমন পরিশোধ করতে হয়, তেমনিভাবে কারও সঙ্গে ওয়াদা করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হয়। অঙ্গীকারকারী ঠিকমতো ওয়াদা পালন করল কি না, সে সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনের ওয়াদা ঋণস্বরূপ।’
প্রকৃত মুমিন ব্যক্তি কখনো তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তাঁরা ওয়াদা রক্ষা করে চলেন। মহানবী (সা.) কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেননি, বরং তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল প্রতীক। নবীজি ওয়াদা করলে যেকোনো মূল্যে তা পালন করতেন। তিনি নিজের সঙ্গী-সাথিদের শত্রুর সঙ্গেও প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ দিতেন। ইসলামি দর্শনে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হুদায়বিয়ার সন্ধি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও কুরাইশদের মধ্যে এ সন্ধিচুক্তি ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু কুরাইশরা যখন এ সন্ধির চুক্তি ভঙ্গ করল, তখন ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অগত্যা এ সন্ধি নাকচ বলে ঘোষণা দেন। নবী করিম (সা.) সাহাবায়ে কিরামদের লক্ষ করে বলেছেন, ‘তোমরা যদি ছয়টি বস্তুর জিম্মাদার হও, তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। ওই ছয়টির অন্যতম হলো ওয়াদা পালন।’
আল্লাহর ভালোবাসা লাভের জন্য ওয়াদা পালনের গুরুত্ব আছে। যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে, আল্লাহ তার ওপর অত্যন্ত খুশি হন। পৃথিবীতে সে সবার কাছে প্রিয়পাত্র ও সম্মানিত হয়; আর পরকালে সে পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ লাভ করে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা না করলে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যারা এক আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী, সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সুমহান আদর্শের অনুযায়ী এবং শেষবিচারের দিনের কথা স্মরণ করে সৎভাবে জীবনযাপনে ইচ্ছুক, এসব ধর্মপ্রাণ লোক কখনো কোনো অবস্থায় ওয়াদার বরখেলাফ করতে পারে না, তথা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘ভদ্রলোক যখন ওয়াদা করে, তখন তা পূর্ণ করে।’
ওয়াদা পালন না করা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা পাপ। যে ব্যক্তি প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা করে না, সমাজে সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। এতে তার সামাজিক মানমর্যাদা হ্রাস পায়। জীবনের উন্নয়নে মানবতার উৎকর্ষ সাধনে পরস্পরের মধ্যকার সম্প্রীতি স্থাপনে অঙ্গীকার রক্ষা করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করার পরিণাম অত্যন্ত শোচনীয়। ওয়াদা পালন মানুষের সামগ্রিক জীবনধারায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ওপর দুনিয়ার সামাজিক শান্তি, সুখ-সমৃদ্ধি ও স্বস্তি এবং পরকালের অনন্ত আরাম-আয়েশের স্থান জান্নাত লাভ নির্ভর করে। তাই ওয়াদা পালনে সচেতন হতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমী, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

No comments

Powered by Blogger.