দুই দু’গুণে পাঁচ-দুর্ঘটনার হালচাল by আতাউর রহমান

গল্প শুনেছিলাম, জনৈক অঘটনঘটনপটীয়ান ট্রাক-ড্রাইভার মালবোঝাই ট্রাক নিয়ে শুকনো মৌসুমে ব্রিজের নিচে গভীর খাদে পড়ে গিয়েও অলৌকিকভাবে প্রায় অক্ষত অবস্থায়ই বেঁচে যান। তো তাঁকে যখন দুর্ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করা হলো, তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি কী করব, বলেন?


বিপরীত দিক থেকে প্রথমে আইলো একটা ট্যাক্সি, ওইটারে সাইড দিলাম। তারপর আইলো একটা বাস, দিলাম ওইটারেও সাইড। তারপর আইলো একটা ব্রিজ, ওইটারে সাইড দিতে গিয়াই না ট্রাকটা খাদে পইড়া গেল!’
গল্পটি মনে পড়ে গেল সম্প্রতি ঢাকার উপকণ্ঠে ভরা মৌসুমে তুরাগ নদে বৈশাখী পরিবহনের একটি বাসের প্রায় ৫০ জন যাত্রীসহ ঝাঁপ দেওয়া ও প্রাণহানির ঘটনায়। বাসটির নাকি অপর একটি বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে চলাটাই দুর্ঘটনার মূল কারণ। তো পাশ্চাত্যে এক মোটরগাড়ির চালককে মাত্রাতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালনাকালে পুলিশ পাকড়াও করলে পর তিনি যখন প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কি খুব স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলাম?’ তখন পুলিশ প্রত্যুত্তরে বলেছিল, ‘না, আপনি খুব নিচু দিয়ে উড়ছিলেন।’ আর এমনিতেও বলা হয়ে থাকে যে একটি গাড়ি তৈরিতে হাজারো নাট লাগে, অথচ একজন মাত্র ‘নাট’ ওগুলোকে রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আরও বলা হয়ে থাকে যে গাড়ি চালানোটা সত্যিকারের আমুদের হতো, যদি প্রত্যেক চালক যে পরিমাণ হর্ন বাজায়, সেই পরিমাণ তার ব্রেইনটা ব্যবহার করত।
সে যা হোক, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা বুঝি আমাদের পিছু ছাড়তে চাইছে না। মাস দুয়েক আগে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে ‘নিরাপদ সড়ক’ শীর্ষক কর্মশালায় সরকারের যে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইতিপূর্বে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে তাঁর দুই মেয়ে হারানোর ঘটনা বর্ণনা করে আমাদের কাঁদালেন, মাস খানেকের মধ্যে তিনি নিজেই সেটার শিকারে পরিণত হয়ে আত্মীয়স্বজনকে শোকসাগরে ভাসালেন। আর আগের দিনের তুরাগের ট্র্যাজেডি যেন যথেষ্ট নয়, তার ঠিক পরের দিনই রেল দুর্ঘটনায় সিরাজগঞ্জে কতগুলো প্রাণ হারিয়ে গেল, রেলের ইঞ্জিনের তীব্র, কানফাটা হুইসেলও তাদের টনক নড়াতে পারল না। আমি রাজনৈতিক নেতিবাচক কথায় গেলাম না।
আর মোটরগাড়ির আবিষ্কারক দেশ হচ্ছে আমেরিকা এবং সে দেশে মোটরগাড়ির সংখ্যাও প্রচুর, প্রত্যেক নাগরিকের বিপরীতে গড়ে দুটি করে গাড়ি; কিন্তু মোটরগাড়ি আবিষ্কারের আগে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনই ছিল বেশি। এ কারণে ওই দেশে বলা হয়ে থাকে যে মোটরগাড়ি ঘোড়াদের বংশ শেষ করেছে, এখন মানুষের বংশ (দুর্ঘটনার মাধ্যমে) শেষ করার তালে আছে। অবশ্য উচ্চ জন্মহারকে ধন্যবাদ, মোটরগাড়িগুলো যে পরিমাণ মানুষ মারছে, তার চেয়ে অধিক পরিমাণে মানবশিশু জন্মগ্রহণ করছে বলেই না রক্ষা। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশের বেলায়ও বুঝি ব্যাপারটা প্রযোজ্য। অথবা বলা যেতে পারে, এটা ‘মালথুসিয়ান থিওরি’—প্রকৃতি নিজেই মাঝেমধ্যে বাড়তি জনসংখ্যা ছাঁটাই করার দায়িত্ব নেয়—এর যথার্থতা এসব ঘটনাই হয়তো প্রমাণ করে। দুর্ঘটনা ঘটে দুর্ঘটনাক্রমেই। ব্যাপারটা বিষাদময় বটে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিশেষত পাশ্চাত্যে অনেক প্রাসঙ্গিক মজার কাণ্ডকারখানাও ঘটে থাকে বৈকি!
এক ভদ্রলোক মোটর দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির জন্য এসেছেন। ডাক্তার সাহেব তাঁকে ‘আপনি কি বিবাহিত’ জিজ্ঞেস করতেই তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু বিশ্বাস করুন ডক্টর, আমার বউ কিছু করেনি, আমি গাড়ি চালাতে গিয়ে নিজেই আহত হয়েছি।’ বারান্তরে তিনি বাইরে থেকে ফিরে এসে দেখেন তাঁর বউ গাড়ির রং বদলে ফেলেছেন, গাড়িটাকে লম্বালম্বি ঠিক দুই ভাগ করে অর্ধেকে দিয়েছেন নীল রং ও বাকি অর্ধেকে দিয়েছেন হলুদ রং। স্বামীর জিজ্ঞাসার উত্তরে স্ত্রী জানালেন, ‘আমি এক্সিডেন্ট করে অনেকবার সাক্ষীর সাক্ষ্যে ধরা পড়েছি। এবারে গাড়ির দুই পাশে দুই রং দিলাম এ কারণে যে আদালতে সাক্ষীদের উল্টাপাল্টা সাক্ষ্যের বদৌলতে আমি পার পেয়ে যাব—কেউ বলবে গাড়ির রং নীল, আর কেউ বলবে হলুদ।’
আরও আছে। শহরের চৌরাস্তার মোড়ে দুই মোটর গাড়িতে মুখোমুখি সংঘর্ষ। চালক দুজন উত্তেজিত অবস্থায় নিজ নিজ গাড়ি থেকে নামতেই তাঁদের একজন এগিয়ে এসে প্যান্টের পকেট থেকে চ্যাপটা হুইস্কির বোতল বের করে অপরজনকে বললেন, ‘এরূপ অবস্থায় নার্ভ ঠান্ডা রাখতে হয়। নিন, একটু হুইস্কি পান করুন।’ অপর ব্যক্তি সানন্দে সেটা গ্রহণ করে খানিকটা পান শেষে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘আপনিও একটু পান করুন।’
‘না, আমি করব না, কারণ এক্ষুনি পুলিশ আসবে।’ প্রথমোক্ত ব্যক্তি জানালেন। অর্থাৎ বুদ্ধি করে নিজেকে রক্ষা ও অপরজনকে ফাঁসিয়ে দেওয়া, এই আর কি!
বহু আগে বিলেতে অবস্থানকালে একটি কার্টুন দেখেছিলাম—একজন লোক হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ক্রাচে ভর করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।
একজন পথচারী তাকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘হ্যাভ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট? (Have an accident)?’ সে বোঝাতে চেয়েছিল, ‘আমার কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে নাকি?’
কিন্তু লোকটি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বুঝে উত্তর দিল, ‘নো, থ্যাকংস, আই হ্যাভ অলরেডি গট ওয়ান, অর্থাৎ না, ধন্যবাদ, আমি ইতিপূর্বে অ্যাক্সিডেন্টে আছি, কাজেই নতুন করে আরেকটির দরকার নেই।’ দৃশ্যটি মনে মনে কল্পনা করে দেখুন, না হেসে পারেন কি না।
আর বিলেতের উল্লেখে মনে পড়ে গেল, আমি গাড়ি চালনা শিখেছি আশির দশকে বিলেতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে পদায়নকালে। তো প্রথম দিনই সাদা সুন্দরী ইনস্ট্রাক্টর গাড়িতে আমার পাশে বসে যে কথাটি বলেছিলেন, সেটা সুন্দরী মহিলার মুখ-নিঃসৃত বলেই কি না জানি না, আজ অবধি আমার স্মরণে আছে। গাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘রিমেম্বার, দিস্ থিং ক্যান কিল পিপল’; অর্থাৎ স্মরণ রাখবেন, এই জিনিস মানুষ মারতে পারে। পত্রিকায় প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুসারে আমাদের দেশে গাড়িচালকের মোট সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখ। একটি কথা প্রচলিত আছে যে, মিথ্যা হচ্ছে তিন প্রকারের—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও পরিসংখ্যান; তা সত্ত্বেও ধরে নিলাম, দেশে গাড়িচালকের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখই। এই সাড়ে ১৩ লাখ লোক গাড়ি চালনাকালে পূর্বোক্ত কথাটা মনে রাখলে কতই না মঙ্গল হতো!
আর কাহাতক রেলগাড়ির অ্যাক্সিডেন্টের প্রশ্ন, রেলগেট না থাকা ও খোলা থাকায় দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ রেল ও মোটরগাড়ি সংঘর্ষজনিত অ্যাক্সিডেন্টের কারণ। তো রেললাইনের পাশে বসবাসকারী এক যুবক চলে গেছে রেলের ঘুমটিঘরের দারোয়ানের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ট্রেন দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে, এদিকে দেখা গেল ছোট্ট ব্রিজ ভাঙা। তুমি কী করবে?’ ছেলেটি উত্তর দিল, ‘আমি লাল কাপড় উড়িয়ে ড্রাইভারকে সতর্ক করে দেব।’ আবারও প্রশ্ন করা হলো, ‘যদি এতে কাজ না হয়?’ ছেলেটি এবার একগাল হেসে বলল, ‘তাহলে দৌড়ে গিয়ে আমার ছোট বোনকে ডেকে নিয়ে আসব, কারণ তার ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট দেখার খুব শখ।’
এবং মোটরগাড়ির সার্বিক বিমা করা থাকলে দুর্ঘটনায় পতিত হলে পর ক্ষতিপূরণ দাবি করা যায়। আর এ নিয়েও বেশ মজার মজার গল্প আছে।
এখানে আমি মাত্র দুটো তুলে ধরছি। একটি বিমা কোম্পানির দাবিপত্রে একটা প্রশ্ন ছিল, ‘দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য অপর ড্রাইভার কী করতে পারতেন?’ দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল পার্কিংয়ের সুনির্দিষ্ট জায়গায়। অতএব বিমা দাবিকারী ফরম পূরণকালে লিখলেন, ‘তিনি অন্যত্র গাড়ি পার্কিং করতে পারতেন।’ আর দ্বিতীয় গল্পটি প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পেশ করা যাক: (গরুর সঙ্গে গাড়ির সংঘর্ষের পর)
প্রশ্ন: সংঘর্ষের আগে আপনি অপর পার্টিকে কি সতর্কসংকেত দিয়েছিলেন?
উত্তর: হর্ন।
প্রশ্ন: অপর পার্টি আপনাকে কি সতর্কসংকেত দিয়েছিল?
উত্তর: হাম্বা।
শেষ করছি আরেকটি প্রাসঙ্গিক মজার গল্পটি দিয়ে। দুর্ঘটনায় পতিত একটি স্বচালিত মোটরগাড়ির চালককে অজ্ঞান অবস্থায় নিকটস্থ একটি পেট্রলপাম্পে নিয়ে আসা হলো।
সেখানে জ্ঞান ফিরতেই তিনি হাত-পা ছুড়ে পালাতে চাইলেন, অনেক কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করা গেল। অতঃপর কারণটা প্রকাশ পেল—পাম্পটা ছিল `Shell’ কোম্পানির। কিন্তু কে একজন পাম্পের হোর্ডিংয়ে লেখা `Shell’ শব্দটির `S’ অক্ষরটাকে তখন আড়াল করে দাঁড়ানোর জায়গাটাকে `hell’ তথা নরক মনে করে তিনি পালিয়ে যেতে চাইছিলেন।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.