জননায়ক-সব খুন নয় সমান by ফারুক ওয়াসিফ

সবার জীবন সমান মূল্যবান নয়, সবার মৃত্যুও নয় সমান। সব খুনও সমান নয়। সব মানুষ সমান, সবার মৃত্যুই সমান দুঃখজনক, ইত্যাদি নীতিকথা কবে কর্পূরের মতো উবে গেছে! তাই কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমানের মৃত্যু সংবাদপত্রের এক দিনের খবরের বেশি কিছু নয়।


তাঁর পরিবার ভুলবে না, এলাকাবাসীও অনেক দিন তাঁর সাহসের কথা মনে করবে, কিন্তু বাকি সবাই ভুলে যাবে। কেননা, নতুন নতুন হত্যাকাণ্ড আমাদের মনোযোগ দখল করে রাখবে। আগের হত্যাকাণ্ড যদি ভয়াবহ হয়, পরেরটি হবে বিভীষিকাময়। আমরা দর্শকের মতো সেসব দেখে যাব আর হা-হুতাশ করব।
কিন্তু একজন দর্শক থাকতে চাননি, বখাটেদের হাতে উত্ত্যক্ত হওয়া ছাত্রীদের ডাকে তিনি সাড়া দিতে গিয়েছিলেন। জবাবে খোদ আজরাইল দুই বখাটের ঘাড়ে চড়ে তাঁর জান কবচ করে নিয়ে গেছে। স্বনামধন্য দুই বখাটে ছাত্রকে সতর্ক করায় তারা মোটরসাইকেলে করে এসে পিটিয়ে মুমূর্ষু করে ফেলে চলে গেছে তাঁকে। আর তিনি উঠলেন না। আহত হওয়ার পরের ১২ দিন জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে ঝুলতে ঝুলতে অবশেষে তিনি পড়ে গেলেন সেই খাদের অন্ধকারে, যার নাম মৃত্যু, যেখান থেকে কেউ আর উঠে আসে না। ৩৬ বছর বয়সী এক যুবক শিক্ষকের জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল। অথচ তাঁরও তো ছিল একটাই জীবন। সেই জীবনের মায়া তিনি করলেন না কেন? তিনি কি জানতেন না, সারা দেশেই বখাটে ও সন্ত্রাসীদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ না-কেউ খুন হচ্ছে। কোনো বিরোধিতাই যে তারা সহ্য করে না, তাও তো তাঁর জানা থাকার কথা! সবাই সবকিছুই জানে বিধায় বেশির ভাগ মুখ বুজে সয়ে যায় বা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অপকর্ম ঘটতে দেখে। বাকিরা দেখে টেলিভিশনে।
সাক্ষী সবাই-ই, কিন্তু সবাই সাড়া দেয় না। যাঁরা দেন, তাঁদের জীবনের মায়া কারও থেকে কম, এমন নয়। তাঁদের হয়তো বিবেকের তাড়া বেশি, নিজ থেকেই তাঁরা দায়িত্ব নিতে এগিয়ে যান। তাঁদের এই একাকী এগিয়ে যাওয়ায় অনেকের উপকার হয়, কিন্তু এর খেসারত হিসেবে যে অপমান, লাঞ্ছনা কিংবা মৃত্যুর ইনাম অপেক্ষা করে, তা নেওয়ার সময় কেউ তাঁদের পাশে থাকে না। আমরা কেবল টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে তাঁদের মৃত মুখচ্ছবি মাঝেমধ্যে দেখি। কেবল দেখিই, তারপর পাতা উল্টে পড়ি অন্য খবর কিংবা চ্যানেল পাল্টে চলে যাই অন্য দৃশ্যে। কেননা, এ দেশে কেবলই খবর আর কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়।
নাটোরের সানাউল্লাহ নূর কিংবা সিরাজগঞ্জে ছয়টি মৃত্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেও ‘সামান্য’ এক কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমানের মৃত্যুতে কেউকেটা মানুষজন নড়েচড়ে বসবে না। এই মৃত্যু প্রধান বিরোধী দলের কাছেও প্রধান কোনো মনোযোগ পায়নি এবংপাবে না। রাজনৈতিক খুন আর ‘সাধারণ’ খুনের মধ্যে তফাত করতে আমরা শিখে গেছি।
মিজানুর রহমান এটাও হয়তো জানতেন না, সব অপরাধ আর সব অপরাধী সমান নয়। কেউ আহার করে, কেউ করে ভোজন আর কেউ স্রেফ খায় বা গেলে। তেমনই রাজনৈতিক কর্মীর অপরাধ অনেক সময় ‘রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে যায়। কারও বেলায় অতিবিচার হয় আর কারও বেলায় হয় অবিচার। নাটোরের গামা হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের অনেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমা পায় আর সানাউল্লাহ নূরের হত্যার এজাহারভুক্ত ২৬ আসামির ২৫ জনই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়, কিন্তু পার হয়ে যায় ১৭টি দিন। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জে ট্রেন পোড়ানোর দায়ে এরই মধ্যে ৭৬ জনের জেলের ভাত নিশ্চিত। যে দেশে সবার জীবন ও মৃত্যু সমান নয়, সে দেশে সব অপরাধীকেও এক চোখে দেখা সম্ভব হয় না।
সরকার, রাজনীতি এবং আইন ও পুলিশ যখন এ রকম একচোখে দুরবিন আর আরেক চোখে ঠুলি পরে থাকে, তখন সমাজে নৈরাজ্য উপস্থিত হয়। নৈরাজ্য মানে ঘোলা পানি, যখন স্পষ্ট করে কিছু দেখা যায় না, যখন যা হওয়ার কথা নয় তা-ই হয় এবং যা হওয়া খুবই প্রয়োজন, তা কোনোমতেই হয় না। ঘোলা পানিতে তাই অনেকে সহজেই শিকার হয়ে যান। তেমনি একদিকে সৎ ও সাহসী মানুষ অপমানিত-নির্যাতিত ও কোণঠাসা হচ্ছেন, অন্যদিকে যাবতীয় অপরাধীরা অবাধে চলাফেরা করে। অপরাধীরা ভেসে উঠছে আর সাহসী ও সৎ মানুষ ডুবে যাচ্ছেন মিজানুরদের মতো। আগে মিজানুরের মতো সাহসী ও নিঃস্বার্থ মানুষই রাজনীতিতে বন্দিত হতেন, এখন রাজনীতিপালিত দুর্বৃত্তদের হাতে তাঁরা নিহত হন। এখন এ ধরনের মানুষের কোনো সংগঠন নেই, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা কেউ করে না। অথচ অপরাধীরা বড় দল দুটির মধ্যে দারুণভাবে সংগঠিত। রসুনের কোয়ার মতো তারা ক্ষমতার আঁটির সঙ্গে জুড়ে আছে।
বড় দুটি দলের রাজনীতিই এখন অপরাধ আর অপরাধীদের সবচেয়ে বড় ছাতা, যার নিচে থাকলে তাদের ভয়ডর কমে যায়, দুঃসাহস বেড়ে যায়। তখন যা কিছু দখলযোগ্য আর যা কিছু ভোগযোগ্য, সেসব হাসিল করায় তারা বুনো ষাঁড়ের মতো মরিয়া হয়ে যায়। মিজানুরের হত্যাকারীদের একজন রাজন। সে ছিল কলেজছাত্র দোহা হত্যা মামলার আসামি। সেই মামলার উচিত পরিণতি হলে সমাজ অন্তত এক নিবেদিতপ্রাণ নারী নির্যাতক ও অকুতোভয় খুনির হাত থেকে বাঁচত; হয়তো মিজানুরও বাঁচতেন।
মিজানুরের মৃত্যু কেবল ব্যক্তির মৃত্যু ভাবলে ভুল হবে, অবিচার হবে তাঁর দায়িত্বশীলতার প্রতি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়াবে, অন্তত তাকে ‘না’ বলবে। এটা সর্বজনীন সর্বকালীন অধিকার। এটা ছাড়া মানুষ মানুষই নয়। মিজানুর যা করেছিলেন, তা সব নাগরিকেরই দায়িত্ব। কিন্তু একা সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুবরণের জন্যই তিনি বীর, তাঁর মতো মানুষই আমাদের সময়ের নায়ক। কিন্তু অজস্র খলনায়কের ভিড়ে তাঁদের জীবনের মতো মৃত্যুও পাচ্ছে না যোগ্য মর্যাদা।তাঁদের বিপরীতে এই মানুষকে যদি আমরা বীরের মর্যাদা না দিই, যদি হত্যা করে করে, ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে, অপমানে অপমানে কাবু করে তাঁদের উঠে দাঁড়ানোর সাহসকে স্তব্ধ করে দেওয়া হতে থাকে, তাহলে এই সমাজ আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না। তখন নীতির জায়গা নেবে দুর্নীতি আর প্রতিবাদ বাতিল বলে গণ্য হবে।
সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যেমন আমাদের জানমালের জিম্মাদার, তেমনি আইন-নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারেরও উৎস। কিন্তু সেই উৎস থেকে যখন জানমালের বিরুদ্ধে আঘাত আসে, যখন তা অন্যায় ও দুর্নীতির আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠে, তখনই মিজানুরের মতো মানুষের প্রয়োজন বড় হয়ে ওঠে। সে কারণেই তাঁর জীবনের চেয়ে তাঁর মৃত্যুই বড়। সে কারণেই অনেকের নীরব থাকার চেয়ে একজনের উঠে দাঁড়ানো অনেক শক্তিশালী। সে জন্যই লোকমানপুরের সর্বস্তরের জনতা মিজানুরের মৃত্যুকে বীরের মৃত্যুর মর্যাদা দিয়েছে। ইভ টিজারের মতো কোমল বিশেষণধারীউদগ্র পুরুষদের আধিপত্য থেকে নারীদের মুক্ত করাই হতে পারে এই মৃত্যুর যোগ্য সরকারি প্রতিদান।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.