রূপগঞ্জ-জমির অধিকার, সাধারণের বনাম ‘অসাধারণের’ by মোশাহিদা সুলতানা ও মাহা মির্জা

রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জে ১৩ হাজার বিঘা জমিতে ২৭ হাজার প্লটের সেনা আবাসন প্রকল্প (আর্মি হাউজিং স্কিম বা এএইচএস) গড়ে তোলার পরিকল্পনাটি এখন আমরা সবাই জানি। কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা আন্তর্জাতিক মানের।


প্রকল্প এলাকায় পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, বিপণিবিতান, হাঁটার পথসহ সবার ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকবে। প্রকল্পের ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত আবাসনের জন্য আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়ির ছবি এবং ভেতরের বিভিন্ন কক্ষের কিছু মডেল নকশা দেওয়া হয়েছে। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরের সূত্রে আরও জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের অক্টোবর মাসে সেনাবাহিনীর আবাসন সমস্যা মেটাতে এএইচএস প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এর অনুমোদন দেন।
এতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু ওয়েবসাইটের কোথাও বলা হয়নি, এই ২৭ হাজার প্লটের জন্য যে ১৩ হাজার বিঘা জমি দরকার, সেই বিশাল ভূখণ্ডের বর্তমান মালিক কারা। বাপ-দাদার ভিটা, অথবা জীবিকার একমাত্র অবলম্বন ধানি জমি একটি আন্তর্জাতিক মানের আবাসিক প্রকল্পের হাতে ছেড়ে দিতে তারা আদৌ সম্মত হয়েছে কি না।
বলাই বাহুল্য, ধানি জমিতে আবাসিক প্রকল্প বা উন্নয়ন প্রকল্পের এই রীতি এ দেশে নতুন নয়। কোথাও নীরবে, কোথাও সরবে ভূমি অধিগ্রহণের নামে ভূমি দখলের তাণ্ডবলীলা চলছে দেশজুড়েই। ঢাকা শহরে মানুষের চাপ বাড়ছে হু হু করে। সেই হিসেবে স্বাভাবিক নিয়মেই শহর বাড়বে, নগরায়ণ হবে, আবাসিক প্রকল্পের সংখ্যাও বাড়বে। কিন্তু গত দুই দশক ধরে নগরায়ণের যে হিংস্র রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তাকে কেবল ‘অপরিকল্পিত’ বললে কম বলা হয়। আবাসিক প্রকল্পের নামে সাধারণ মানুষের জমি হাতিয়ে নেওয়া, দখল করা, কৃষককে ঠকিয়ে মোটা টাকার ব্যবসা করা এই চক্রটির কর্মকাণ্ড নগরায়ণের মতো সুন্দর শব্দ দিয়ে আড়াল করা যাবে না।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্বাস্তু করে, বহুমুখী প্রকল্পের নামে ধানি জমি দখল করে নেওয়ার এই অন্যায়, অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে পূর্বাপর সরকারের নীরবতা আমাদের অবাক করে। আরও অবাক করে এ বিষয়ে সুষ্ঠু কোনো নীতিমালার অভাব। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই হাইড্রলিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করতে গিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলের বসবাসযোগ্য ৫৪ হাজার একর জমি পানিতে ডুবে যায়। সেই তৎপরতা এখনো চলছে। ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি নিয়েও এ কথা বলা যায়। সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি করতে হলে কয়েক লাখ লোককে উচ্ছেদ হতে হবে, বিপর্যয় ঘটবে বিরাট এলাকার পরিবেশের। প্রতিবাদে সেখানকার মানুষ বিরাট আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে তিনজন।
কক্সবাজার ও কুয়াকাটা থেকে প্রতিনিয়ত খবর আসছে পর্যটনকে কেন্দ্র করে কৃত্রিম উপায়ে জমির মূল্য বৃদ্ধির তৎপরতার। ঢাকা শহরের আবাসিক প্রকল্পগুলোই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে জমি হস্তান্তরের নাম করে বিশেষ শ্রেণী জমি কেনাবেচা থেকে বড়সড় রকমের মুনাফা করে চলেছে। তারা যেমন স্বল্প মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধানি জমি কিনে নিচ্ছে, তেমনি জমির বাজারদরও নিয়ন্ত্রণ করছে কৃত্রিমভাবে।
ঐতিহাসিক ও বর্তমান ভূমি-ব্যবসার প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে রূপগঞ্জের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। যদিও রূপগঞ্জে ঘটে যাওয়া এ ঘটনার ব্যাখ্যা করছে মিডিয়া বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ ঢালাওভাবে সামরিক শক্তির সমলোচনা করছে, কেউ বলছে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য গ্রামবাসীকে উসকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে স্বীকারও করা হয়েছে যে এই বিশাল এলাকার জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি বাস্তবসম্মত ছিল না। কিন্তু এত সব বিশ্লেষণের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ। প্রায় ১৩ হাজার বিঘা জমি অধিগ্রহণের অবাস্তব ও অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ যে এলাকাবাসীর অধিকার রক্ষারই আন্দোলন, সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করা হচ্ছে না।
রূপগঞ্জের বেশির ভাগ মানুষ তাদের জমি ও জীবিকা আবাসিক প্রকল্পের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ১৩ হাজার বিঘা জমি মানে কেবল নিষ্প্রাণ মাটির দলা নয়। এগুলো গ্রাম, লোকালয়, বংশপরম্পরায় মানুষের আবাসভূমি ও শস্যখেত। এখানে বাঁধা আছে অগণিত মানুষের ঘর, সংসার, মাথা গোঁজার নিশ্চিন্ত ঠাঁই, ফসলের গোলাঘর, সবজির বাগান, গবাদিপশু, মাছের পুকুর, ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ ও স্কুলঘর। তারা ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করেছে নিজেদের ভিটেমাটি, ঘরদুয়ার, শস্যের জমি কোনো আন্তর্জাতিক মানের আবাসিক প্রকল্পের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়। নগদ টাকার বিনিময়ে কি কৃষকের জমি ও জীবিকার ক্ষতিপূরণ হয়? নিশ্চিন্তে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর বাপ-দাদার শেখানো কৃষিকাজ ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে উপচে পড়া শহরের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকে কি?
ধানের জমিতে আধুনিক আবাসিক প্রকল্প হলে শহরের পরিধি বাড়ে বটে, কিন্তু সেই শহুরে নাগরিকদের খাদ্যনিরাপত্তা কি নিশ্চিত হয়? কৃষককে মুদির দোকানি বা রিকশাচালক বানিয়ে শহরের আধুনিক মানুষ খাদ্য রপ্তানি করে পেট ভরাবে কত দিন?
১৬ কোটি মানুষের দেশে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যচাহিদার দেশে যেটুকু ফলনশীল জমি এখনো রয়ে গেছে, সেটুকু জানপ্রাণ দিয়ে রক্ষা করাই কি আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল না? কিসের ভরসায় আবাসিক প্রকল্পের হাতে হাজার হাজার বিঘা ধানি জমি তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন শহরের মানুষ এবং তথাকথিত নীতিনির্ধারকেরা? কিসের ভরসায় আমরা ভুলে থাকি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ আর জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীজুড়েই চলছে খাদ্যসংকট? সে ক্ষেত্রে খাদ্যঘাটতি পূরণে রপ্তানিমুখী হওয়ার সুযোগটিও কমে আসছে একে একে। তাই ধানি জমি রক্ষায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কঠোর নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে না পারলে, শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই নয়, অত্যাধুনিক আবাসিক প্রকল্পে বসবাসকারী ভদ্রলোকদেরও তার খেসারত দিতে হতে পারে।
রূপগঞ্জের মানুষ তাও প্রতিবাদ করেছে। নিজের কমিউনিটি, নিজের জায়গাজমিতে বিলাসী অ্যাপার্টমেন্ট হবে, আধুনিক সুপার মার্কেট হবে, এটা তারা মানতে পারেনি। যেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমি ‘অধিগ্রহণের’ মাধ্যমে প্রকাণ্ড সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে আসছে এই বাংলাদেশে, তাদের অংশগ্রহণ তো দূরে থাক, তাদের অভিমত গ্রহণ বা তাদের কথা বলার সুযোগটা কতটা থাকে? এমন পরিস্থিতিতে এলাকাবাসী প্রতিবাদ করবে, কৃষক তার জীবন-জীবিকার শেষ সম্বল জমিটুকু ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই পুরো বিষয়টি এলাকাবাসীর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ হিসেবে না দেখে, স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
আবাসিক প্রকল্প হোক আর উন্নয়ন প্রকল্পই হোক, সাধারণ মানুষকে, কৃষককে এবং আদিবাসীকে স্বল্প মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করার যে অপতৎপরতা চলে আসছে এত দিন ধরে, রূপগঞ্জের স্ফুলিঙ্গ তার বিরুদ্ধে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠার দাবি রাখে।
মোশাহিদা সুলতানা: প্রভাষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মাহা মির্জা: জার্মানি প্রবাসী গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.