লম্পট প্রেসিডেন্ট চাই না by মাহমুদ শামসুল হক

১৯৮৭ সাল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটি অভিনব জনমত জরিপ হয়েছিল আমেরিকায়। জরিপটি পরিচালনা করে বিখ্যাত লাইফ ম্যাগাজিন ও নর্দার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনমত গবেষণা কর্তৃপক্ষ। এতে অংশ নেন প্রতিনিধিত্বশীল ভোটার এবং যেসব এজেন্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রার্থীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কাজ করেছিলেন তারা।

জরিপের শিরোনাম ‘সেক্স বনাম প্রেসিডেন্সি বিতর্ক’। জরিপ শেষে জানা গেল, অংশগ্রহণকারী সবাই একটি বিষয়ে একমত। তা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই জাতীয় নৈতিক ভাবমূর্তির প্রতীক হতে হবে। শতকরা একান্ন ভাগ আর একটু জোর দিয়ে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্টকে সন্দেহাতীতভাবে সাধারণ আমেরিকানের চেয়ে অনন্য হতে হবে। নৈতিকতার দিক থেকে তিনি হবেন আদর্শ মানুষ। তারা আরও খোলাসা করে বলেছিলেন, আমরা কোনো স্খলিত, বিকৃত, বিতর্কিত চরিত্রের প্রেসিডেন্ট চাই না। অর্থাত্ প্রেসিডেন্সি এবং লাম্পট্য পরস্পর সাংঘর্ষিক।
জরিপে একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন ছিল—কখন একজন প্রেসিডেন্টের নৈতিক অবনতি ঘটে কিংবা কোন বিবেচনায় নৈতিক চরিত্রে স্খলন দেখা দিয়েছে বলে মনে করা যায়? এর জবাবে অংশগ্রহণকারী একান্ন জন বলেন, নৈতিক অবনতি তখনই ঘটে, যখন একজন প্রেসিডেন্ট বা প্রার্থী স্ত্রীর প্রতি যত্নবান থাকেন না, স্ত্রীর খোঁজ-খবর নেন না, সর্বোপরি স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ততার মূল্য দেন না। মহিলা ভোটারদের একটি বড় অংশের মত ছিল এরকম—দেশের প্রতি যার বিশ্বস্ততা নেই, তারই এ ধরনের স্খলন ঘটে। আরেকটি প্রশ্ন ছিল, আমেরিকার কোন প্রেসিডেন্ট এদিক থেকে ভালো আছেন? জরিপ অনুসারে এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান (১৯৪৫-১৯৫৩ খ্রি.)।
জরিপটি থেকে এও প্রমাণিত যে, আমেরিকানরা কোনো তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেতে রাজি নন। সে দেশের প্রেসিডেন্সির ইতিহাসে স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এমন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাত্র একজন। আর একজন অবিবাহিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক দলের জেমস বুচানান (১৮৫৭-১৮৬১ খ্রি.)। আলোচ্য জরিপে অবিবাহিত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর পক্ষে মত দেন সাকুল্যে দু’জন।
এবার দেখা যাক, নৈতিকতার প্রশ্নে বিখ্যাত আমেরিকানরা কী চিন্তাভাবনা করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন (১৯৬৯-৭৪ খ্রি.) যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির দায়ে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন তিনি বলেছেন, ব্যক্তিগত নৈতিকতা কোনো লোকের পূর্ব যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের (১৯৭৭-৮১ খ্রি.) স্ত্রী ফার্স্টলেডি রোজালিন কার্টারের সাফ জবাব, কোনো লোকের ব্যক্তিগত চরিত্র নষ্ট হওয়া মানে তার চাকরি চলে যাওয়া। সেক্স, রাজনীতি ও গোপনীয়তা প্রসঙ্গে মত প্রকাশ করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন জেরালডিন ফেরারো। ইনি আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন ডেমোক্র্যাটিক দলের পক্ষ থেকে। তার কথায়, ব্যক্তিগত নৈতিকতা প্রতিটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো লোকই এ ব্যাপারে পুরোপুরি সজাগ নন। আমি কারও গার্লফ্রেন্ড আছে কী নেই তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। তবে আমার স্বামীর যদি কোনো গার্লফ্রেন্ড থাকে তবে নিশ্চয়ই মাথা ঘামাব। আমরা আমাদের জাতীয় নেতার ব্যাপারে সবাই আগ্রহী। স্বভাবতই আমরা শুদ্ধ চরিত্র পছন্দ করি। একাধিক প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী অধিকর্তা এবং অভিজ্ঞ নির্বাচনী কর্মকর্তা ডটি লরেন্স ছিলেন মধ্যপন্থী। তিনি বলেছিলেন, আমেরিকার বেশিসংখ্যক দম্পতি বিয়েজীবনের ইতি টানেন তালাকের মাধ্যমে। তারা বিয়ে ছাড়াও যৌনজীবন পালন করে থাকতে পারেন। আসল সমস্যা হলো নির্বাচন প্রার্থী ও নির্বাচিতদের নিয়ে।
আলোচ্য জরিপের কাজটি যখন চলছিল তখন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জজ সিনিয়র বুশ এবং প্রতিপক্ষ গ্যারি হার্ট নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তখন জনমত ছিল গ্যারির পক্ষে; প্রায় নিরঙ্কুশ ভোটে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা। শেষতক ফেঁসে গেলেন তিনি। বুশ সমর্থকরা জনসমক্ষে প্রমাণপত্র দাখিল করলেন যে, সুন্দরী ডোনা রাইসের সঙ্গে গ্যারি হার্টের অনৈতিক সম্পর্কে রয়েছে। ব্যস, রাতারাতি আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় ধস। নির্বাচিত হলেন বুশ। ‘কেনেডি ইজ আওয়ার রেমেডি’ বলে গর্ব করত আমেরিকানরা। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন স্ত্রী জ্যাকুলিনের বদান্যতায় এবং প্রণয়িনী মেরিলিন মনরোর আকস্মিক মৃত্যুতে। নইলে খবর ছিল। ৪৩তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনের আগেভাগে কালিমাছন্ন হয়েছিলেন। ডজন দেড়েক সুন্দরীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা চাউর করেছিল বিভিন্ন গণমাধ্যম। শেষতক রক্ষা করলেন স্ত্রী হিলারি। টেলিভিশনের পর্দায় যখন কাঁদো কাঁদো গলায় হিলারি দেশবাসীকে বললেন যে, আমার স্বামী স্খলিত চরিত্রের লোক নন, তখনই একেবারে পাল্টে গেল নির্বাচনী হাওয়া। ক্লিনটন জিতলেন।
অথচ এই আমেরিকাকে যৌননৈতিক দিক থেকে উদার দেশ বলা হয়। সেখানে সমকামিতা, লিভিং টুগেদার, বিয়ের আগে সন্তান নেয়া আইনের দৃষ্টিতে সিদ্ধ। কিন্তু জাতীয় নেতা, দেশের প্রধান নির্বাহী অর্থাত্ প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্য শীর্ষ পদাধিকারীদের চরিত্র স্খলনের কোনো মাফ নেই। প্রাচ্যের জাপানও অনেকটা এরকম। বিয়ের পর নৈতিকতার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় জাপানিরা। সেখানে নৈতিকতার প্রশ্নে এ নাগাদ একগুচ্ছ প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কিংবা নির্বাচনে হেরেছেন। ইংল্যান্ডে এমনটি হয়েছে বহুবার, ফ্রান্সেও।
বরং রক্ষণশীল দেশগুলোই এক্ষেত্রে ঢিলেঢালা। পাকিস্তানের একাধিক প্রেসিডেন্ট যৌননৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন, ভারতের কতিপয় পদস্থ রাজনৈতিক নেতাকে নিয়েও ঢের বদনামি কথা উঠেছে। আমাদের দেশে একজন প্রেসিডেন্টকে নিয়েও কম মন্দাচারি হয়নি। কিন্তু তা কখনও রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠেনি। কোনো নির্বাচনে এসব ঘটনা প্রভাব বিস্তার করেছে বলেও মনে হয় না। যৌননৈতিক ব্যাপারে উদার ও রক্ষণশীল সমাজের এই বৈপরীত্য বিস্ময়কর বৈকি!

No comments

Powered by Blogger.