মধুপুর বন জ্বলছেঃ এক্ষুনি আগুন নেভান

বাংলাদেশের চার বিখ্যাত বনাঞ্চলের কোনোটিই আর সুরক্ষিত নেই। ব্রিটিশ আমলের শেষদিক থেকে যে উজাড় প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাতে আর কোনো ছেদ পড়েনি। সব সরকারের আমলেই বন মন্ত্রণালয় আর বনরক্ষীদের চোখের সামনে খাঁ-খাঁ প্রান্তরে পরিণত হয়েছে একদার নিবিড় বনভূমি।

এমনকি অভয়ারণ্য বলেও আক্ষরিক অর্থে কিছু নেই বলা চলে। স্বভাবতই বনজবৃক্ষের পাশাপাশি সাবাড় হয়েছে হাজার রকমের মূল্যবান ঔষধি গাছ-গাছড়া, লতাগুল্ম। নিশ্চিহ্ন হয়েছে অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি। যেগুলো টিকে আছে আজও, সেগুলোও নানা উপদ্রবে অস্থির। বন উজাড় আর বনজ প্রাণীর বিনাশ শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্যকেই চূড়ান্তভাবে মলিন করেনি, ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বৃক্ষের অভাবে ভূমিধস বেড়েছে, নদী ভরাট হচ্ছে, কমে গেছে বৃষ্টিপাত, কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে মরুপ্রবণতা। সবমিলিয়ে হ্রাস পেয়েছে মাটির উর্বরাশক্তি। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন, সচেতন মানুষ প্রতিবাদ করেছে; কিন্তু কোনো সরকারই বিষয়টি আমলে আনেনি। বর্তমান সরকারের আমলে বন উজাড়ের কাজ চলছে প্রায় নির্বিবাদে।
বন বিনাশের সবচেয়ে ভয়াবহ উপায় হচ্ছে শুকনো মৌসুমে আগুন লাগিয়ে দেয়া। এতে ছোট গাছ, লতাগুল্ম, গাছ থেকে পড়া বীজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আগুনের তাপে মরে যায় অনেক বড় গাছও। একইসঙ্গে সমূলে নির্বংশ হয় পশুপাখি-কীটপতঙ্গের আবাসস্থল। সম্প্রতি সেই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে দেশের অন্যতম বনভূমি মধুপুর বনাঞ্চলে। বরাবরের মতো এবারও এই শুকনো মৌসুমে ভূমি জবরদখলকারী, শিকারি এবং রাখালরা বনের বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। এভাবে নিচে জমে থাকা শুকনো পাতায় প্রতিদিন দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। গাছের এই আমূল বিনাশ, প্রাণীর নির্বংশ হওয়ার ব্যাপারে বনরক্ষক থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কেউ সাড়া দিচ্ছেন না। পরোক্ষভাবে তারা যেন মুমূর্ষু বনভূমির মুখাগ্নি করছেন। সেই চিন্তায় আত্মাহুতি দিচ্ছে গাছসহ অসংখ্য জীবজন্তু। মধুপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মধুপুর বন জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জের বিভিন্ন স্থানে এবং লোহুরিয়া ও দোখনা বিটের অনেক জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে ১ মার্চ পর্যন্ত। এ নিয়ে ২ মার্চ সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দাবদাহ ও অন্য কারণে বনভূমিতে আগুন লেগে গেলে সে দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তা বিস্ময়কর! আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণ আগুন নেভানোর কাজে নেমে পড়ে। আমাদের দেশে ঘটে এর বিপরীত। এমনকি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ বলে পরিচিত সুন্দরবন পরপর দুটি ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হওয়ার পরও সেখানে বনদস্যুদের উত্পাত বন্ধ করতে পারেনি সরকার। কাঠ চুরি হচ্ছে, মারা পড়ছে বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন প্রাণী। অন্য দুই বনাঞ্চল সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনেও উজাড় প্রক্রিয়া থেমে নেই। পাশাপাশি প্রকাশ্যে পাহাড় কেটে সমভূমিতে পরিণত করছে দখলবাজ ভূমিদস্যুরা। বনের জায়গায় ইটভাটা জ্বলছে। খাস বনের কাঠ হচ্ছে তার ইন্ধন। সরকার তথা বন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে আক্ষরিক অর্থেই উদাসীন।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমির প্রয়োজন। বাংলাদেশে এখন রয়েছে মাত্র পাঁচ ভাগ। মধুপুর, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভাওয়ালগড়, সুন্দরবন—এর কোনোটিকেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন স্থাপনাসহ বনে গড়ে উঠেছে বৃহত্ শিল্পকারখানা। চাষাবাদ চলছে, কাঠ পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। শিকার হচ্ছে পশুপাখি। কিন্তু কার গোয়ালে কে দেয় ধোঁয়া! সেই পুরনো অভিযোগ, এসব হচ্ছে বন মন্ত্রণালয়ের মূঢ়মতি অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে। এছাড়া দুর্বৃত্তদের মদত দিচ্ছে ভূমি প্রশাসনের দুষ্ট লোকজন। তাদের সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে ভূমিদস্যুরা দখল করছে বনের জমি। এখন পুড়ছে মধুপুর বন। বনাঞ্চলের চার রেঞ্জের ১০ বিটে প্রতিদিন চোখে পড়ছে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য। অথচ তা চোখে পড়ছে না বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের। অভিযোগ আছে, জনবল কম বলে কর্তারা চোখ বুজে থাকছেন। আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি নেই, পানির সঙ্কট, ফায়ার সার্ভিস সময়মত পাওয়া যায় না ইত্যাদি ছুতো।
সরকার তথা বন মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমাদের আহ্বান, আপাতত বনের আগুন নেভানোর জরুরি ব্যবস্থা নিন। বন বাঁচান। নইলে এ আগুনের আঁচ সবার গায়েই লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.