সময়ের প্রেক্ষিত-পরমাণু বিদ্যুৎমুক্ত জাপান by মনজুরুল হক

পরমাণু বিদ্যুতের পথে জাপানের যাত্রা আজ থেকে ৪৬ বছর আগে, ১৯৬৬ সালে ইবারাকি জেলার তোকাই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম চুল্লিটি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে গত সাড়ে চার দশকে অবশ্য সারা দেশে পরমাণু চুল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪টিতে দাঁড়ায়, যেসব চুল্লি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অল্প কিছুদিন আগেও জাপানের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৩০ শতাংশের জোগান দিয়ে আসছিল।
ফলে পরমাণু বিদ্যুৎ একসময় হয়ে ওঠে জাপানের বিদ্যুৎব্যবস্থার সবচেয়ে নির্ভরশীল মাধ্যম। সেই সঙ্গে নব্বইয়ের দশক থেকে বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বিষয়টি আলোচনায় চলে এলে পরমাণু বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতার যৌক্তিকতা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন করে আসছিলেন, তাঁরা ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়েন এবং জাপান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ খাতে পরমাণু বিদ্যুতের অংশীদারি ৫০ শতাংশে উন্নীত করে নেওয়ার বলিষ্ঠ পরিকল্পনা ঘোষণা করে।
সে রকম অবস্থায় মাত্র বছর খানেক আগে পর্যন্ত পরমাণু বিদ্যুতের জন্য সবকিছু ঠিকভাবেই চলছিল এবং দেশের প্রধান একটি বিদ্যুৎ কোম্পানি, টোকিও বিদ্যুৎশক্তি (টেপকো) দেশের অনুকরণযোগ্য একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হচ্ছিল। তবে পরমাণু বিদ্যুতের গোছানো সেই সংসার একেবারে পুরোপুরি লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে ২০১১ সালে জাপানের প্রধান দ্বীপ হোনশুর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের ওপর আঘাত হানা ভূমিকম্প ও সুনামি জলোচ্ছ্বাস।
আমরা জানি, প্রাকৃতিক সেই দুর্যোগ কেবল তাৎক্ষণিক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েই দাঁড়ায়নি, সেই সঙ্গে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অচল করে দিয়ে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার দানবীয় চরিত্রকেও আমাদের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছে। ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। পরে সেখানে এক এক করে ছয়টি পরমাণু চুল্লি বসানো হয় এবং এর অল্প দূরে আরও চারটি চুল্লি নিয়ে গড়ে ওঠে ফুকুশিমার দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত বছরের মার্চে আঘাত হানা দুর্যোগের পর থেকে সেই ১০টি চুল্লির সব কটি যে কেবল বন্ধ হয়ে আছে তা-ই নয়, এক নম্বর বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি চুল্লিতে পরমাণু বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় যেটাকে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পর্যায়ের মেল্ট ডাইন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়—তা-ই ঘটে গেছে। সে রকম অবস্থায় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার বোতলবন্দী দানব এখন বোতল থেকে বের হয়ে নিজের খেয়ালখুশিমতো তেজস্ক্রিয়তা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারপাশের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসরত ৮০ হাজার লোকজনকে দীর্ঘমেয়াদি সময়ের জন্য তাদের বাড়িঘর ও ঘরদুয়ারের যাবতীয় জিনিসপত্র রেখে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। এদের অনেকেরই হয়তো বাকি জীবনে আর নিজেদের শখের গড়ে নেওয়া স্বপ্নের নীড়ে ফিরে যাওয়া হবে না।
ফুকুশিমার দুর্ঘটনা অবশ্য পরমাণু বিদ্যুতের যৌক্তিকতার বিতর্ক আবারও সামনে নিয়ে আসে এবং দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিণতি এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে দেশবাসীর মনে দেখা দেওয়া সংশয় আরও ঘনীভূত করে তোলে। চলমান সেই বিতর্কের একটি বিষয় হচ্ছে, পরমাণু বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা আসলেই যুক্তিসংগত কি না। জাপানে অবশ্য পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ঘিরে এই বিতর্ক চলে আসছে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সেই সূচনার দিনগুলো থেকে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব সামনে রেখে চলা সেই বিতর্কে বিরোধীরা কখনোই তেমন সুবিধা করে নিতে পারেনি। অন্যদিকে বাড়িঘর থেকে শুরু করে শিল্প ও বাণিজ্যের সব কটি খাতে বিরতিহীন বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা জনগণ ভোগ করে চলায় জনমতও কখনোই পরমাণু বিদ্যুতের বিপক্ষে সেভাবে সোচ্চার হয়ে ওঠেনি। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল দুর্ঘটনা পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধীদের অবস্থানে সাময়িক জোয়ারের টান নিয়ে এলেও অচিরেই তা আবার অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশের আড়ালে চাপা পড়ে যায়।
জাপানের ভেতরেও যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন সব সময় ঝামেলামুক্ত ছিল তা অবশ্য নয়। দেশের নিজস্ব ফাস্ট ব্রিডার পরমাণু চুল্লি মঞ্জুর দুর্ঘটনাকবলিত হওয়া সাময়িকভাবে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও দেশের মানুষ অল্প দিনেই তা আবার ভুলে যায় এবং সরকারও বুলেট ট্রেনের লাইন ফুকুই জেলায় সম্প্রসারিত করার টোপ ফেলে মঞ্জু আবারও চালু করার অনুমতি স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। টোকিওর অল্প দূরের তোকাইমুরার দুর্ঘটনার বেলায়ও অনেকটা যেন একই নাটকের পুনঃমঞ্চায়ন হতে দেখা গেছে। তবে এবারের দুর্ঘটনা ব্যাপ্তির দিক থেকে আগের সবকিছুকে সবদিক থেকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় সরকারকেও পরমাণু বিদ্যুতের বিষয়টি নতুন করে বিবেচনা করে দেখতে হয়েছে এবং সে রকম অবস্থান থেকেই গত বছরের দুর্ঘটনার পর পরমাণু বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে দেওয়া নির্দেশে বলা হয়েছিল, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পরমাণু চুল্লি নিয়মিতভাবে বন্ধ রাখার সময় এগুলোর ভূমিকম্প সহ্য করার ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার পরই চুল্লি পুনরায় চালুর ছাড়পত্র দেওয়া হবে। সরকারের সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫৪টি পরমাণু চুল্লির সব কটি পর্যায়ক্রমে পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষার জন্য বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে এবং সেই ধারা অনুসরণ করে উত্তরের হোক্কাইডো দ্বীপের তোমারি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিন নম্বর চুল্লিটি ৫ মে মধ্যরাতের কিছু আগে বন্ধ হয়ে গেলে জাপানে এখন আর পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে না।
তবে এর অর্থ অবশ্যই এ রকম নয় যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে জাপান ইতিমধ্যে সরে এসেছে। জাপানের পক্ষে এ মুহূর্তে তা সম্ভবও নয়। দেশের অর্থনীতি বিদ্যুৎব্যবস্থার বিরতিহীন সরবরাহ লাইনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে চটজলদি অন্য কোনো বিকল্পে সরে যাওয়াও জাপানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। ফলে বন্ধ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করতে হলে কী করা দরকার, সরকারও মনে হয় সেই প্রশ্নে হিমশিম খেতে শুরু করেছে।
পরমাণু চুল্লির ভূমিকম্প সহ্য করার সামর্থ্য পরীক্ষায় প্রথম যে দুটি চুল্লি ইতিমধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে, জাপান সাগরের উপকূলীয় ফুকুই জেলার ওইতে অবস্থিত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের সেই দুই চুল্লি পুনরায় চালু করা নিয়ে দেখা দেওয়া বিতর্ক বিষয়টিকে এখন আরও জটিল করে তুলছে। জাপানের জনমত এ মুহূর্তে পরমাণু জ্বালানির বিরোধী। সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা যায়, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ চাইছে জাপান যেন পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসে। তবে সবচেয়ে বড় যে বাধার মুখোমুখি সরকার ও বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে হতে হচ্ছে তা হলো, স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের আপত্তি। জাপানের যেসব জেলা ও শহরে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত, সেই সব জেলার গভর্নর ও শহরের মেয়ররা কিছুদিন আগে বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করার আগে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও উন্নত করে নিয়ে স্বচ্ছভাবে তা জনতার সামনে তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন। ফলে পরীক্ষায় পাস করার পরও ফুকুই জেলার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালুর ছাড়পত্র এ মুহূর্তে পাচ্ছে না।
অন্যদিকে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ জাপানকে খরচ করতে হওয়ায় জাপানের ৩২ বছরের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত গত বছর ঘাটতির দিকে নেমে গেছে। আর তাই সবদিক থেকেই পরমাণু বিদ্যুৎ প্রসঙ্গটি সরকারের সামনে এখন এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজমান, যার সমাধান খুব সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে রাজনীতির ঘোলাজলে মাছ শিকারের বাসনায় রাজনীতিবিদদের একাংশও বসে নেই। ঠিক সে রকম এক রাজনীতিবিদ হচ্ছেন ওসাকার তরুণ মেয়র তোরু হাশিমোতো। কট্টর দক্ষিণপন্থী ধারণায় বিশ্বাসী, বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দৃঢ় সমর্থক এই রাজনীতিক রাজনৈতিক বিভাজনে বরাবর বামপন্থীদের সমর্থন করে যাওয়া পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে ঘোষণা করেছেন, ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের সিংহভাগ ওসাকায় ব্যবহূত হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকিপূর্ণ পুনরায় উৎপাদন তিনি সমর্থন করবেন না।
জাপান অবশ্য ইতিমধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুতের অংশীদারি ৫০ শতাংশে বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিকো নোদার সরকার চাইছে পরমাণু বিদ্যুতের ওপর দেশের নির্ভরশীলতা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে। ফলে বলা যায়, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে আসা ইতিমধ্যে জাপানের গৃহীত এক সিদ্ধান্ত। পরমাণু বিদ্যুতের ঝুঁকির দিকটি বিবেচনা করেই নাগরিক স্বার্থে জাপানকে এটা করতে হয়েছে। জাপানের মতো সবদিক থেকে অগ্রসর একটি দেশ ও নাগরিকদের যে ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখা যাবে তা নিশ্চিত হতে পারেনি। অন্যদিকে আমরা এখন সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথেই স্বদর্পে পদচারণের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি। একেই বোধ হয় বলতে হয় ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! যার পরিণতি একসময় ভোগ করতে হতে পারে দেশের মানুষকে।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.