বিচারের বাণী ... by মাহবুব তালুকদার

গুরুদেব প্রার্থনা করিতেছিলেন। তাহার এই প্রার্থনা যোগাসনে বসিয়া ধ্যানস্থ হওয়ার অনুরূপ নহে। প্রার্থনাকালে তাহার মুখমণ্ডল বিষাদাচ্ছন্ন ছিল। তিনি অস্পষ্টস্বরে যাহা বলিতেছিলেন, শিষ্যের নিকট তাহা বোধগম্য হইল না। সে নীরবে সম্মুখে উপবিষ্ট থাকিয়া গুরুদেবের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিল।

এক সময়ে গুরুদেবের প্রার্থনা শেষ হইলে তিনিও নিশ্চুপ হইয়া বসিয়া রহিলেন। উভয়ের দীর্ঘ নীরবতায় সময় অতিবাহিত হইল। কিছুকাল পরে গুরুদেব কহিলেন, অদ্য প্রাতঃকাল হইতে আমি বিষাদাক্রান্ত হইয়াছি। কিছুতেই অন্তর সুস্থির হইতেছে না।
উহার কারণ কি প্রভু? শিষ্য জিজ্ঞাসিল।
এক বত্সর পূর্বে এই দিনে বিডিআর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছিল। জাতির জীবনে ইহার অধিক বড় ট্রাজেডি আর নাই। আমার মনে হয় সমগ্র জাতি আজ শোকে মূহ্যমান।
এই অভাবনীয় ঘটনা সম্পর্কে আমার মনে কতিপয় জিজ্ঞাসার উদয় হইয়াছে। শিষ্য কহিল।
আমরা তাহা লইয়া আলোচনা করিতে পারি।
মহাত্মন! একটি বত্সর অতিক্রান্ত হইলেও আমরা অদ্যাবধি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ জানিতে পারিলাম না। এই বিষয়ে যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হইয়াছে, উহাদের কোন রিপোর্টই সূর্যের আলো দেখিতে পায় নাই। সিআইডি’র তদন্ত রিপোর্ট এখনো তৈয়ারি হয় নাই এবং উহার তদন্তও শেষ হয় নাই। ইতোমধ্যে বিচারকার্য শুরু হইয়াছে।
তোমার বক্তব্য ঠিক। তবে প্রথম হইতেই লক্ষ্য করা গিয়াছে যে, তদন্তকে বিপথগামী করিবার প্রচেষ্টা বিদ্যমান।
উহা কি রূপে প্রভু?
গুরুদের বলিলেন, ঐ সময়ে সরকারি তদন্ত কমিটির পাশাপাশি সেনাবাহিনীও পৃথক তদন্ত পরিচালনা করে। উহার সমন্বয়ের দায়িত্ব প্রদান করা হইয়াছিল বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল ফারুক খানকে। ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ তিনি বলিয়াছিলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে জঙ্গিরা দেশের সুশৃঙ্খল বিডিআর বাহিনীকে ব্যবহার করেছে।’ কিন্তু সিআইডি’র প্রধান তদন্তকারী অফিসার পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্পষ্টভাবে বলিয়াছেন, এই হত্যাকাণ্ডে কোন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় নাই। শিষ্য জানাইল।
বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য লইয়া তত্কালে বিতর্ক সৃষ্টি হইলে তিনি অবশ্য তাহার বক্তব্য হইতে রাইট টার্ন করিয়া বলিয়াছিলেন, উহা তাহার নিজস্ব বক্তব্য।
স্যার! সত্যি বলিতে কি বিডিআর বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ আজ পর্যন্ত দেশবাসীকে জানানো হয় নাই। বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম বলিতেছেন, বিডিআরের কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা ও ডাল-ভাত কর্মসূচি লইয়া বিভ্রান্তির কারণেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। শিষ্য আরও বলিল, এই ঘটনা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের জন্য যথেষ্ট কারণ হইতে পারে না। এই ঘটনায় মোট ৭৪ জন নিহত হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহাদের এহেন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রহিয়াছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক বক্তব্যে আমি বিভ্রান্ত।
প্রধানমন্ত্রীর কোন বক্তব্যে তুমি বিভ্রান্ত?
শিষ্য বর্ণনা করিল, গত বত্সরের ১ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলিয়াছিলেন, কোন দাবি-দাওয়ার বিষয় নয়, পিলখানায় সুপরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হইয়াছে। কাহারা বিডিআর-জনতা ভাই ভাই শ্লোগান দিয়া বিদ্রোহীদের উত্সাহিত করিয়াছিল, সেই তথ্য তাহার নিকট আছে। অন্যদিকে ৭ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় তিনি বলিয়াছিলেন, পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র হইয়াছিল। ৭ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দীর্ঘ বক্তৃতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই বিরোধী দলের পক্ষ হইতে প্রতিশোধ লইতে পিলখানায় হত্যাকাণ্ড ঘটানো হইয়াছে।
শিষ্যের দীর্ঘ বক্তব্যের মাঝখানে গুরুদেব কহিলেন, বত্স! তুমি কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বলিতেছ। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্য বলিতেছ না কেন?
অতঃপর শিষ্য কহিল, হুজুর! এই প্রসঙ্গে আমি তাহাও তুলিয়া ধরিতে চাহি। ১ মার্চ জাতীয় সংসদে পিলখানা হত্যাকাণ্ড লইয়া সরকারের সমালোচনা করিয়া বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ঘটনার ব্যাপকতা না জানিয়া সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ঠিক হয় নাই। সমঝোতার নামে অপরাধীদের সহিত আলোচনায় বসা ও বিদ্রোহীদের নেতাকে বিডিআরের ভারপ্রাপ্ত ডিজি বানানো উচিত ছিল না। বিদ্রোহীদের রাতের অন্ধকারে পালাইয়া যাওয়ার সুযোগ করিয়া দেয়া সরকারের শৈথিল্যের প্রমাণ। অতঃপর ৭ মার্চ বেগম জিয়া জাতীয় সংসদে দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেন, ঘটনাকালে সেনাপ্রধানের দায়িত্বহীনতা প্রমাণিত। তিনি সেনা কর্মকর্তাদের বাঁচানোর জন্য অভিযান পরিচালনা করেন নাই কেন? বেগম জিয়া আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী ও তাহার পুত্র লেদার লিটনের নেতৃত্বে বিডিআর ৫ নম্বর গেটে যে মিছিল হয়, ঐ ঘটনাকে আড়াল করিতে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা উহা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করিতে কেন ইঙ্গিত করিয়াছিলেন যে ঐ মিছিল বিরোধী দলের লোকেরা আয়োজন করে? বেগম জিয়ার এই সব প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়া যায় না।
বত্স! পিলখানার হত্যাযজ্ঞ অত্যন্ত মর্মান্তিক সন্দেহ নাই। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড লইয়া সরকারি দল ও বিরোধী দল পরস্পরকে দোষারোপ করা কম মর্মান্তিক নহে।
শিষ্য কহিল, ইহাতে ঘটনার মূল প্ররোচকগণ সম্ভবত অলক্ষ্যে বসিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতেছে এবং দোষারোপের রাজনীতি রীতিমত উপভোগ করিতেছে।
তুমি যথার্থ বলিয়াছ। গুরুদেব বলিলেন, একটি বত্সর অতিবাহিত হইবার পর এখনও ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতৃবৃন্দ পরস্পরকে সরাসরি জড়িত বলিয়া দাবি করিতেছেন।
মহাত্মন! গোস্তাকি মাফ করিলে আরেকটি বিষয় এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিতে চাই।
তুমি নির্ভয়ে বলিতে পারো।
সরকার পক্ষ হইতে বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার প্রধান আইনজীবী আনিসুল হক এবং বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম বারংবার বলিতেছেন যে, কোন নিরপরাধ বিডিআর সদস্য যাহাতে সাজা না পায় এবং কোন অপরাধী যাহাতে শাস্তি হইতে পরিত্রাণ লাভ না করে, তাহা নিশ্চিত করা হইবে। কিন্তু এই বক্তব্য কতখানি আন্তরিকতাপূর্ণ সে বিষয়ে আমার মনে দ্বিধা জাগিতেছে।
তোমার এইরূপ দ্বিধার কারণ কি?
প্রভু! বিগত এক বত্সরের ঘটনা প্রবাহই আমার মনে এহেন সন্দিগ্ধতা জাগাইয়া তুলিয়াছে।
তুমি ইহার কারণ ব্যাখ্যা করিতে পারিবে কি?
ঢাকাসহ দেশের যে ৭টি স্থানে বিডিআর বিদ্রোহের বিচারকার্য চলিতেছে, তাহাতে দেখা যায় অনেক অভিযুক্ত সদস্য তাহাদের পূর্বে প্রদত্ত জবানবন্দি প্রত্যাহার করিতে আবেদন জানাইয়াছেন। তাহাদিগকে নির্যাতনের মাধ্যমে ঐ সকল জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হইয়াছিল বলিয়া তাহারা আদালতকে জানান। কিন্তু এক্ষণে ঐ সাক্ষ্যগুলিই তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হইতেছে।
বিষয়টি আদালতের বিবেচ্য বলিয়া মনে করি। গুরুদেব বলিলেন।
আরও একটি বিষয় উত্থাপন সঙ্গত বলিয়া মনে হয়।
বাছা! তোমার দ্বিধার কোন কারণ নাই।
শিষ্য কহিতে থাকিল, আটক বিডিআর সদস্যদের নির্যাতনের ব্যাপারে তাহাদের পরিবার হইতে অভিযোগ তোলা হয়। আটকাবস্থায় এবং রিমান্ডকালে কিছুসংখ্যক বিডিআর সদস্যের মৃত্যু লইয়া মানবাধিকার সংগঠনগুলি প্রশ্ন তোলে। বিডিআর কর্তৃপক্ষ জানাইয়াছেন, এই পর্যন্ত ৭১ জন বিডিআর সদস্য মারা গিয়াছে। তাহাদের অনেকের শারীরিক সমস্যা ছিল এবং অনেকে আত্মহত্যা করিয়াছে বলিয়া জানানো হয়। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা জানাইয়াছেন যে, এ সকল মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, এত দীর্ঘ সময় একজন মানুষকে আটক রাখা সম্পূর্ণ অমানবিক ও আইন বহির্ভূত।
সরকারের নিযুক্ত মানবাধিকার কমিশনের অভিমত কি? গুরুদেব জিজ্ঞাসিলেন।
তাহাদের কোন অভিমত পাওয়া যায় নাই। শিষ্য জানাইল, কর্তৃপক্ষের হেফাজতে থাকা বিডিআর সদস্যের মৃত্যু সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়া বিডিআর মহাপরিচালক জানাইয়াছেন, ‘তদন্তের জন্য রিমান্ডে এনে নির্যাতন করার বিষয়ে আমার কাছে প্রশ্ন না করে রিমান্ডে যে কর্তৃপক্ষ আনে তাদেরকে করতে হবে।’
হ্যাঁ। দুটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাপারে মামলা হইয়াছে। এই মামলার ফলাফলে বোঝা যাইবে, ওইসব মৃত্যুর জন্য কে বা কাহারা দায়ী। গুরুদেব কহিলেন, বত্স! তুমি পিলখানা হত্যাকাণ্ড লইয়া এতক্ষণ কেবল ঘটনা বর্ণনা করিলে। কিন্তু তোমার নিজের অভিমত ব্যক্ত করিলে না।
মহাত্মন! আমার প্রথম অভিমত হইল বিডিআর হত্যাকাণ্ড লইয়া রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক রেষারেষি ও ফায়দা লোটার প্রচেষ্টা বন্ধ করা উচিত। একে অপরের প্রতি দোষারোপের ধারা অব্যাহত থাকিলে ঘটনার মূল কারণ অন্বেষণ ব্যাহত হইবে। আমরা সত্য জানিতে চাহি।
তুমি ঠিক বলিয়াছ।
আমি আরো মনে করি, যাহারা এই ঘটনার জন্য দায়ী, তাহাদিগকে শাস্তি প্রদান প্রধান উদ্দেশ্য হইলেও, নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীগণকে চিহ্নিত করিয়া সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
সাধু! আমি তোমার সহিত ঐকমত্য পোষণ করিতেছি। গুরুদেব কহিলেন, এই বিদ্রোহের জন্য যাহারা দায়ী অবশ্যই তাহাদের প্রত্যেকের শাস্তি হওয়া উচিত, তবে নিরপরাধ কাহাকেও শাস্তি প্রদান উচিত হইবে না। সততা, নিরপেক্ষতা ও আন্তরিকতার সহিত এই উদ্দেশ্যের পরিপালন বাঞ্ছনীয়। আর—
আর কি প্রভু?
বিচারের বাণী যেন নীরবে নিভৃতে না কাঁদে!
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.