জাহাজভাঙা শিল্প-আইন ভেঙে প্রণীত হলো নীতি! by ফখরুল ইসলাম

সর্বোচ্চ আদালতের রায়, আন্তর্জাতিক ও দেশের আইন এবং পরিবেশবাদীদের সব যুক্তি ও আবেদন উপেক্ষা করে সংশোধিত হলো আমদানি নীতি আদেশ (২০০৯-২০১২)। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখা এবং ‘উদীয়মান’ জাহাজভাঙা শিল্পের বিকাশের স্বার্থে এ সংশোধনী আনা হয়েছে।


কিন্তু সুস্থ মানুষের বুঝতে বাকি নেই, এটি করা হয়েছে মূলত আইন মানতে নারাজ জাহাজভাঙা শিল্প-মালিকদের সিন্ডিকেটের চাপে।
দেশে বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে আমদানি নীতি আদেশটি করা হয়। সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অত্যন্ত স্ববিরোধীভাবে জাহাজের ‘ইনবিল্ট বর্জ্য’ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদিও দেশে দেশে এ শিল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাহাজের নিজস্ব (ইনবিল্ট) বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায়!
ভাঙার জন্য আমদানি করা জাহাজগুলোতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর যেসব পদার্থ থাকে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্ন প্রকারের ধাতু, এজবেস্টস, লেদ, পিবিসি, টিবিটি ও পিসিবি। এসব বর্জ্যের সংস্পর্শে মানবদেহে ফুসফুস, বুক ও তলপেটের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। মারাত্মক এসব বর্জ্যের বিষক্রিয়া এড়াতে উন্নত বিশ্ব তাদের মালিকানাধীন জাহাজগুলো নিজেদের দেশে ভাঙে না। ইউরোপীয় দেশগুলো তাই জাহাজগুলোর মালিকানা বদলে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ ও ভারতের গুজরাটে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ভাষ্য অনুযায়ী, পরিবেশ ও শ্রম আইনের প্রয়োগ যেসব দেশে দুর্বল সেসব দেশকেই বেছে নেওয়া হয় জাহাজভাঙার স্থান হিসেবে। বাংলাদেশ তাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা।
বাংলাদেশের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। বছরের পর বছর পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই জাহাজ ভাঙা হচ্ছে সীতাকুণ্ড সমুদ্র উপকূলে। দেশের উপকূলীয় পরিবেশকে ধ্বংস করে দিয়ে, পানি দূষণ করে আর বন উজাড় করে চলছে এ শিল্প। আশ্চর্যজনক যে উন্মুক্ত সমুদ্রসৈকতকে ইয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করে বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের ন্যূনতম কোনো সুবিধা ছাড়াই পরিচালিত জাহাজভাঙা কার্যক্রমকে সরকার শিল্প হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত ও অরক্ষিতভাবে পরিচালিত এ শিল্পে মৃত্যু আর পঙ্গুত্ব বরণ করছেন শ্রমিকেরা।
অনিয়ন্ত্রিত এ শিল্পকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হাইকোর্ট ৫ ও ১৭ মার্চ ২০০৯ কিছু নির্দেশ দেন। জাহাজের নিজস্ব বর্জ্য নিরাপদে অপসারণে বাংলাদেশে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বর্জ্য শ্রমিক দেহে এবং পরিবেশে যে মারাত্মক বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করছে, তা বিবেচনায় হাইকোর্ট ভাঙার উদ্দেশ্যে আমদানি করা সব জাহাজকে বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই বর্জ্যমুক্ত করে আনার নির্দেশ দিয়েছেন। সে মোতাবেক সরকারও গত ২৬ জানুয়ারি জারি করা আমদানি নীতি আদেশে শর্ত আরোপ করে যে সব জাহাজকে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বর্জ্যমুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আসতে হবে। অর্থাৎ আদালতের রায় পুরো অনুধাবন করেই প্রণীত হয় এ নীতি-আদেশ।
কিন্তু এ শর্ত মানবেন না জাহাজভাঙা শিল্পের প্রভাবশালী মালিকেরা। তাঁদের যুক্তি, এ শর্ত মানতে গেলে জাহাজ আমদানি সম্ভব নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এ শর্তটি বিপজ্জনক বর্জ্যের আন্তরাষ্ট্রীয় চলাচলসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বাসেল কনভেনশনের অংশ, যা মেনে চলতে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো বাধ্য। অন্য বাস্তবতা হচ্ছে, পৃথিবীতে কেবল পাঁচটি দেশ ছাড়া অন্য সব দেশ নিজস্ব পরিবেশ আইন মেনে চলার কারণে জাহাজ ভাঙতে পারে না।
যেহেতু এ শিল্প দেশের ৮০ ভাগ লোহার চাহিদা মেটায় এবং প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ লোকের কর্মসংস্থান করে। তাই এ শিল্পে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে থমকে যাবে উন্নয়ন—এ অজুহাতে আন্দোলন শুরু করেন জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকেরা। অথচ এ দুটি দাবি সর্বৈব অসত্য। ৩১ জানুয়ারি, ২০০৮ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয় ‘প্রকৃত তথ্য’ শীর্ষক জাহাজভাঙা শিল্পের মালিকদের নিজস্ব বিবৃতি। সে বিবৃতিতে শিল্পমালিকেরা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে দেশের লোহার চাহিদার মাত্র ২৫ ভাগ তাঁরা পূরণ করেন। বাকি ৭৫ ভাগ চাহিদা আমদানি করে মেটাতে হয়।
প্রশ্ন হলো, ৭৫ ভাগ লোহার চাহিদা যদি আমদানির মাধ্যমে মেটানো যায়, তবে বাকি ২৫ ভাগ চাহিদা মেটাতে দেশকে বিদেশি বিষাক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত করা কার স্বার্থে? লোহার খনির মালিক ১৪টি দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলো লোহার চাহিদা কীভাবে পূরণ করে? প্রতিবেশী দেশ মালদ্বীপ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন যদি আমদানি করেই লোহার চাহিদা মেটাতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না? সহজ উত্তর হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
এ শিল্পে দেড় লাখ শ্রমিকের সরাসরি কর্মরত থাকার তথ্য সংসদে উপস্থাপন করা হলেও এর সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন মতে, এ শিল্পে কর্মরত স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার এবং মোট শ্রমিকের সংখ্যা আঠারো হাজার। কর্মসংস্থানের প্রশ্নে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এ শিল্প টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী নৌপরিবহন, পরিবেশ বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো মন্ত্রী অগ্নিদগ্ধ কোনো শ্রমিককে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন, এমন কোনো সংবাদ এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত চট্টগ্রাম স্টিল মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায় না বেসরকারি খাতে পরিচালিত জাহাজভাঙা শিল্পে! পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল গত আমলের সরকার, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। অথচ মারাত্মক দূষণকারী জাহাজভাঙা শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
জাহাজভাঙা শিল্পের প্রভাবশালী মালিকদের অযৌক্তিক আন্দোলনের মুখে অনেকটা আত্মাহুতি দেওয়ার মতোই নতি স্বীকার করে নেয় সরকার।
১১ এপ্রিল, ২০১০ বদলে যায় মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত আমদানি নীতি আদেশ, রাতারাতি গেজেট হয়ে যায়। এখন থেকে জাহাজে ইনবিল্ট দ্রব্যাদি ব্যতীত অন্য কোনো বিষাক্ত বা বিপজ্জনক বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে না বলে ঘোষণাপত্র দাখিল করে বিষাক্ত জাহাজ বাংলাদেশে ঢুকে যাবে।
এটি একটি চরম অগ্রহণযোগ্য শর্ত। নতুন এ শর্ত প্রকারান্তরে দেশে বর্জ্য আমদানিকে আইনসিদ্ধ করে দিল। বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক আইনের বিধান লঙ্ঘনের পাশাপাশি এ শর্ত ‘জাহাজ বর্জ্যমুক্ত’ করে আমদানি করা সংক্রান্ত আদালতের নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আমাদের দাবি, অবিলম্বে আমদানি নীতি আদেশের সংশোধিত শর্ত প্রত্যাহার করা হোক এবং আগের শর্ত বহাল রাখা হোক। আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জাহাজভাঙা শিল্পকে সুনির্দিষ্ট বিধিমালার আলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিন্ডিকেটের দাবির কাছে মাথা নত না করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো লোহার বিকল্প আহরণে এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এর কোনো বিকল্প নেই।
ফখরুল ইসলাম: সাংবাদিক।
fakhrulharun@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.