বাজেট-চরাঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ চাই by ময়নুল ইসলাম

দেশের অন্যতম দারিদ্র্য পকেট হিসেবে চিহ্নিত চরাঞ্চলে সরকারি বরাদ্দ তুলনামূলক কম। জাতীয় বাজেটেও এর প্রতিফলন চোখে পড়ছে না। আবার কখনও কখনও চরের জন্য আলাদা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ নেই বলেই দৃশ্যমান।


জাতীয় বাজেটে চরাঞ্চল বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে


দেশের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে প্রায় ৬০-৭০ লাখ মানুষের বসবাস। যাদের একটি বড় অংশ আবার দ্বীপচরে বসবাস করে। দ্বীপচরগুলো বরাবরই সংকটাপন্ন এবং মারাত্মক রকম দুর্যোগপ্রবণ। স্বভাবতই দ্বীপচরের মানুষরা অন্যতম প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবেই চিহ্নিত। দ্বীপচরে যাদের বসবাস তারা এক নিয়ত ঝুঁকির মধ্যেই জীবনযাপন করে থাকে। নানামুখী সমস্যা মোকাবেলা করে বেঁচে থাকাটা তাদের জীবন-সংগ্রামেরই অংশ। চরে বহুবিধ সমস্যা আবহমানকাল ধরেই। খাদ্য, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, সুচিকিৎসা, শিক্ষা_ এসব সমস্যাই যেন অনন্তকাল। সমস্যাগুলোর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যও বিচিত্রময়। কিন্তু সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সঠিক পরিকল্পনা নেই। ফলে সব মিলিয়ে চরের মানুষের যেভাবে যতটা সার্বিক অগ্রসর হওয়ার কথা সেটা হচ্ছে না। কিন্তু সবাই বলছে, চরে যে বিপুল সম্পদ রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এবং মানুষগুলোকে আরও বেশি কর্মমুখী করা গেলে চরের মানুষকে দারিদ্র্যবস্থা থেকে বের করা অসম্ভব কিছুই নয়।
আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করছি যে, দেশের অন্যতম দারিদ্র্য পকেট হিসেবে চিহ্নিত চরাঞ্চলে সরকারি বরাদ্দ তুলনামূলক কম। জাতীয় বাজেটেও এর প্রতিফলন চোখে পড়ছে না। আবার কখনও কখনও চরের জন্য আলাদা বরাদ্দ করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ নেই বলেই দৃশ্যমান। জাতীয় বাজেটে চরাঞ্চল বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। সমস্যাবহুল চরের জন্য আলাদা বরাদ্দ যেমন দেওয়া হয়নি, তেমনি আলাদাভাবে গুরুত্বও দেওয়া হয়নি।
চর এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে জাতীয় বাজেটে প্রথমবারের মতো বিশেষ বরাদ্দের ঘোষণা করা হয় ২০০৯-১০ অর্থবছরে। এই বরাদ্দের প্রস্তাবিত পরিমাণ ছিল ১৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পরের বছর (২০১০-১১ অর্থবছর) এই বরাদ্দের প্রস্তাবিত পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৪৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ঘোষণা করেন। প্রথম বছর বাজেট বরাদ্দের ঘোষণায় চরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা সূচক প্রত্যাশা দেখা যায়। তারা বলেন, অনেক পরে হলেও চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারের এই পদক্ষেপে তারা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। দ্বিতীয় বছর চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক বেশি ঘোষণা করা হয়। ফলে চরের মানুষের প্রত্যাশাও পূর্বের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে।
চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এই দু'বছরে যে বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সেবা তাদের কাছে পেঁৗছেনি। বরাদ্দে সুনির্দিষ্টভাবে চরাঞ্চলের জন্য খাত উলেল্গখ না থাকায় বরাদ্দ ও ব্যয়ের কোনো ধরনের তথ্যও জানা সম্ভব হয়নি। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতার (২০১০-১১ অর্থবছর) ১৩১নং অনুচ্ছেদে চর, হাওর, চা বাগান ও দুর্গম এলাকায় শিশুবান্ধব শিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের কথাও ঘোষণা করেন। কিন্তু এ ধরনের কর্মসূচির বাস্তব প্রতিফলন চর এলাকায় লক্ষ্য করা যায়নি। ২০১১-১২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী জানান, হাওরাঞ্চল, চরাঞ্চল ও মঙ্গাপীড়িত উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১০-১১ অর্থবছরে গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পে ১৪ কোটি ১০ লাখ জনদিবস কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু চরাঞ্চলে বসবাসরত ৬০ থেকে ৭০ লাখ জনগোষ্ঠীর (যাদের অধিকাংশই অতিদরিদ্র) জন্য এ ধরনের একটি কর্মসূচির সামান্য অংশ তাদের উন্নয়নে যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়াও পরপর দু'বছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে চরাঞ্চলের কথা উলেল্গখ থাকলেও ২০১১-১২ অর্থবছরে আলাদাভাবে চরের কথা উলেল্গখই করা হয়নি।
চর এলাকায় মানুষ বসবাস করে নানামুখী সমস্যার মোকাবেলা করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রথম শিকারও হয় চরের মানুষ। বন্যা, নদীভাঙন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্রচণ্ড শীতসহ সব ধরনের দুর্যোগে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্ভোগের শিকার হয় এই মানুষগুলো। খাদ্য নিরাপত্তার অভাব ভয়াবহরূপে দেখা যায় এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে। দুর্যোগকালে এই দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। এ ছাড়াও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় চরের মানুষের কাছে নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা পেঁৗছায় না। হতদরিদ্র ও অসুস্থ চরের মানুষের পক্ষে প্রায় গড়ে ১৮ কিলোমিটার দূরে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া সম্ভব হয় না। গর্ভবতী নারী ও নবজাত শিশুদের প্রয়োজনীয় সেবার নূ্যনতম পরিমাণ তাদের কাছে পেঁৗছায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত কাঠামোর অভাব, শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রমে শিশুদের জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন কারণে চর এলাকার সর্বত্র শিক্ষার নাজুক অবস্থা বিদ্যমান। চরে প্রচুর শিশু রয়েছে, যারা কখনোই স্কুলে যায় না।
চর এলাকা সমন্বিত কৃষি উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু যে মানুষগুলো এই জমিতে ফসল উৎপাদন করে তাদের কেউই সেই জমির মালিক নয়। জমির মালিক চরে অনুপস্থিত। তারা ক্ষমতাধর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, যারা চর এলাকায় বসবাস না করেও সুবিধাটুকু ভোগ করে। চরের ক্ষুদ্র বর্গাচাষিরা তাদের কাছ থেকে বছরে বিঘা প্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বন্দোবস্ত নিয়ে জমি চাষ করে। বেশিরভাগ চরের কৃষক এই খরচ বহন করতে না পারায় হয়ে পড়ে বেকার অথবা অভিবাসী শ্রমিক। তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে শহরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। চরে নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা (যেমন_ পলিযুক্ত কৃষিভূমি, বিস্তীর্ণ গোচারণভূমি, প্রয়োজনীয় জনশক্তি) রয়েছে, যার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। এরকম আরও শত সম্ভাবনা রয়েছে চরের মানুষকে ঘিরে। কিন্তু সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা।
দ্বীপচরসহ দেশের সমগ্র চরাঞ্চলের উন্নয়নে আলাদা কর্মসূচি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। কেননা দারিদ্র্যপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে চরের মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় এনে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাইলে চরাঞ্চলের মানুষের জন্য বরাদ্দ সুনির্দিষ্ট সমস্যার আলোকে ও সেই সমস্যার সমাধানে নির্দিষ্ট হতে হবে। আরেকটি জাতীয় বাজেট ঘোষণার সময় আসন্ন। চরের অতিদরিদ্র, অভাবী মানুষরা তাকিয়ে আছে তাদের উন্নয়নে সরকার কী ভূমিকা নেয় তার দিকে। চরের মানুষকে অবহেলা করে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। উপেক্ষা আর বৈষম্য নয়, চরের মানুষের দিকে সহানুভূতির দিকে তাকাতে হবে। চরের অতিদরিদ্র মানুষগুলোকে অবশ্যই মূলধারায় আনতে হবে। জাতীয় বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ সময়ের দাবি। দেশের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে সঠিক ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করছি।

ময়নুল ইসলাম :গবেষক

No comments

Powered by Blogger.