কবির লড়াই নয়, এমপির লড়াই by মাহফুজ উল্লাহ

এতদিন মনে করা হতো বিষয়টি কবিদের। তারাও বিষয়টিকে নিজেদের জগত্ বলেই মনে করতেন। সেখানে অন্য কারও অনুপ্রবেশ ছিল না। কিন্তু এই লড়াইয়ের দর্শক ও শ্রোতা ছিলেন অগণিত মানুষ। এই লড়াই দেখে উপস্থিত অনেকেই আনন্দিত হতেন, কেউ কেউ বিমর্ষও হতেন।

লড়াইয়ে পছন্দের কবি হেরে গেলে দুঃখের শেষ থাকত না। কবির লড়াই নিয়ে সে বিখ্যাত গল্পের কথা হয়তো অনেকেই জানেন। সেখানে এমন একটি ইংরেজি বাক্য ব্যবহার করা হয়েছিল যার অনুবাদ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ ঘায়েল হয়ে গিয়েছিলেন। সঠিক জবাব দিয়েও যে বোকা প্রমাণিত হওয়া যায় এই গল্পই ছিল তার উদাহরণ। কবির লড়াইয়ে যারা অংশ নিতেন তারা ছিলেন মূলত স্বভাব কবি, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে অপরিচিত। তবে ব্যতিক্রম যে ছিল না এমন নয়। আজকের মতো মিডিয়া ব্যাপ্তি থাকলে হয়তো এদের অনেকেই জাতীয় পরিচিতি পেয়ে যেতেন। যারা কবির লড়াই দেখেছেন তারা এটা মানতে বাধ্য হবেন যে, এই মানুষদের সৃজনীশক্তি ছিল অদ্ভুত এবং এর চেয়েও বড় ছিল তাদের প্রত্যুত্পন্নমতিতা। তারা খুব সহজেই চোখের পলক পড়ার আগে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্য কবিতার চরণ বাঁধতে ও আওড়াতে পারতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবির লড়াই দু’পক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কখনও কখনও দুইয়ের অধিক পক্ষ কবির লড়াইয়ে অংশ নিতেন। কবির লড়াই সম্পর্কে লিখতে গেলে আলাদা একটি কিতাবই লেখা যেতে পারে। কিন্তু সে কিতাব এ লেখার বিষয়বস্তু নয়।
সময় ও জনগণের রুচি বদলানোর কারণে কবির লড়াই এখন লুপ্তপ্রায় এক শিল্প। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কবির লড়াই হারিয়ে গেলেও সেই জায়গা দখল করেছেন এমপি বা সংসদ সদস্যরা। ক’দিন পরে এমপির লড়াই হিসেবে এই বাকযুদ্ধ পরিচিত হবে। এমপিরা যে সব সময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হন এমন নয়, কখনও কখনও নিজের দলের লোকের সঙ্গেই তারা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, কখনও একাই এই যুদ্ধ চালিয়ে যান।
অতি সম্প্রতি নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারই দলের অন্য দুই সংসদ সদস্য। দুই সংসদ সদস্য মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করেছেন, যার মর্মার্থ দাঁড়ায় মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন। পাল্টা মন্ত্রী যে বক্তব্য দেন তাতে তিনি ওই দু’জনকে দখলদার হিসেবেও গালি-গালাজ করেন।
এমপিদের এই চরিত্র নতুন নয়। বেশ কিছুদিন আগে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন আইন ও সংসদবিষয়ক পার্লামেন্টারি কমিটির প্রধান শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। সেই বাকযুদ্ধ অনেক দর্শক অর্থাত্ দেশের নাগরিকদের বেশ মজা দিয়েছিল। তবে ভাগ্য ভালো এই বাকযুদ্ধ হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়নি।
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণ আর টিসিবি’র ভূমিকা নিয়ে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন দুই এমপি—ফারুক খান ও আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এরা বাকযুদ্ধে মুখোমুখি হননি কিন্তু তাদের বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতি পরস্পরকে নাম ধরে দোষারোপ না করলেও এটা স্পষ্ট ছিল এদের দু’জনের মধ্যে উপলব্ধির একটা লড়াই চলছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই বাকযুদ্ধ থেমে নেই। কয়েক মাস আগে সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে মন্তব্যকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবাঞ্ছিত বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল সেই মন্তব্যের বাদ সেধেছেন তারই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ভাগ্য ভালো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর পাল্টা জবাব দেননি।
কথার লড়াই দিয়ে এমপিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে আসেন। কিন্তু সে লড়াই সব সময় শোভন হয় না। যেমন ক’দিন আগে সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী চৌধুরী জড়িয়ে পড়েছিলেন বাকযুদ্ধে—সংবর্ধনাস্থলে যেতে না পারার কারণে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে দু’জন এমপি আছেন যারা তাদের বাকযুদ্ধ এবং এর পরিণতিতে হাতাহাতির যুদ্ধের জন্য ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছেন। আবার এক সময় দেখা গেল আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সংসদেই বাকযুদ্ধ শুরু করেছেন। যার কিছুটা গেছে তার দলের বিরুদ্ধে এবং কিছুটা গেছে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে। এই অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও বাকযুদ্ধের কমতি ছিল না। তবে তারা নির্বাচিত ছিলেন না এই যা রক্ষা। তবে এ দেশে একটা কথা চালু আছে আর তা হচ্ছে, চোরের মার বড় গলা। বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা সে কথাটাই প্রমাণ করেছেন।
বাকযুদ্ধ সব সময় খারাপ, এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে গত কয়েক মাসের বাকযুদ্ধে এটা প্রমাণ হয়েছে এমপিরা বাকযুদ্ধে বেশ পটু। বাকযুদ্ধের আরেকটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ’৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে। আইনমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন বেশ সদম্ভে। কিন্তু পহেলা মার্চের সংবাদপত্রে দেখা গেল আরেক এমপি ওবায়দুল কাদের ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে অতটা আশাবাদী নন এবং প্রায় বলেই দিলেন সেখানে ফেরত যাওয়া যাবে না। এমপিদের বাইরেও রাজনীতিবিদরা বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সেটা জনজীবন ও জনপ্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। এমপিরা করেন বলে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ তারা রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পর্কিত থাকেন। যেমন অনেক জায়গায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন এমপিরা। তবে মজার ব্যাপার হলো যে দলই ক্ষমতায় থাকে সে দলের এমপিরা বাকযুদ্ধে অনেক বেশি পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লুপ্তপ্রায় কবির লড়াইয়ের বদলে এমপিদের লড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করলে এটা জনগণের জন্য অনেক সুখদায়ক হবে। জনগণ পরিচিত হবেন নতুন এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে।
বাকযুদ্ধের ব্যাপারে কোনো কোনো এমপি বলতে পারেন তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতার আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ বলতে পারেন তিনি সত্য কথা বলেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব বাকযুদ্ধে যে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ উত্থাপিত তার কোনোটাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। কবির লড়াইয়ের মতো অবস্থা। কিন্তু সাধারণ মানুষ আনন্দ উপভোগ করে। এমপিদের সম্পর্কে যা ভাবার তা ভেবে নেয়। তাদের দুঃখ হয়, এ জন্যই কি এদের নির্বাচিত করেছিলেন?
সংশোধনী
গতকাল প্রকাশিত আতাউস সামাদের লেখা ‘পাহাড়েও জিয়াই নন্দঘোষ!’ শীর্ষক উপসম্পাদকীয় কলামে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ ঘটে গেছে। ওই লেখার প্রথম কলামের ২৫তম লাইনে ‘... গণতন্ত্র ধ্বংসকারী, বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ...’, তৃতীয় কলামের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের ৩২তম লাইনে ‘আবিষ্কার করেছে’ এবং তৃতীয় প্যারাগ্রাফের অষ্টম লাইনে ‘... জন্য ১৯৭২ সালে সিমলায় ...’ পড়তে হবে।
— বি.স.

No comments

Powered by Blogger.