শেকসিপয়ারের গ্লোব থিয়েটারে বাংলায়-দি টেমপেস্ট by জন ফার্নডন

দি টেমপেস্ট শেক্সপিয়ারের একটি অসাধারণ নাটক। এটি লেখা হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ সম্প্রসারণের সুবর্ণযুগে। ডিউক প্রোসপেরোর শাসনামলের শেষদিকে তাঁর সাম্রাজ্যের কয়েকটি দ্বীপকে স্বাধীনতা দেওয়ার ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে নাটকের কাহিনি। আজ থেকে ৪০১ বছর আগে শেকসপিয়ারের গ্লোব থিয়েটারের বিখ্যাত ওপেন এয়ার (উন্মুক্ত) মঞ্চে এই নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল।


এবার সেই গ্লোব থিয়েটারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শেকসপিয়ার উৎসবে দি টেমপেস্ট বাংলা ভাষায় পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে মঞ্চায়ন করেছে বাংলাদেশের ঢাকা থিয়েটার।
দি টেমপেস্ট নাটকে প্রোসপেরোর ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের প্রসঙ্গ। নাটকের নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফের মতে, টেমপেস্ট-এর কাহিনি পুরোনো হলেও শেকসপিয়ারের নাটককে কোনো নির্দিষ্টকালের আবর্তে বাঁধা যায় না। ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত নাট্যকাহিনিতে দৃশ্যত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে নাটকের শেষপ্রান্তে প্রোসপেরো ক্রীতদাস ক্যালিভ্যানকে শুধু মুক্তিই দেননি, তাঁর কাছে দ্বীপের শাসনক্ষমতা হস্তান্তরও করেছেন। মূল চরিত্র প্রোসপেরোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রুবল নূর লোদী।
প্রযোজনাটি ঢাকা থিয়েটার লন্ডনের গ্লোব থিয়েটার আয়োজিত শেকসপিয়ার আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে মঞ্চস্থ করেছে। এই উৎসবে সারা বিশ্বের ৩৭টি ভাষায় শেকসপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ হয়। এটা ঠিক, আমার মতো বাংলা না জানা দর্শকের কাছে নাটকটির সংলাপ বোঝা সম্ভব ছিল না। তবে নির্দেশক হিসেবে নাসির উদ্দীন ইউসুফের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি শেকসপিয়ারের নাটকে আদিবাসী মণিপুরি নৃত্য সংযোজনের মাধ্যমে গোটা নির্মাণে যেমন নতুনত্ব এনেছেন, তেমনি টেমপেস্ট-এর মতো একটি রাজনৈতিক নাট্যকাহিনিতেও লোককথার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
এক শতাব্দী আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় নৃত্যের ছয়টি প্রধান শাখার একটি মণিপুরি নৃত্যকে অবলম্বন করে নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু এখানে নাসির উদ্দীন ইউসুফ কিছুটা ব্যতিক্রমী। মণিপুরি নৃত্যকর নীলমণি সিনহা ও বিধান সিনহার সহায়তায় তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যদের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে এক নতুন অভিনয়শৈলী আমাদের সামনে উন্মুক্ত করেছেন, যা অভিনয় ও নৃত্যের যৌথ সংমিশ্রণে গঠিত।
টেমপেস্ট-এর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দক্ষ নৃত্যশিল্পী নন। ধ্রুপদি নৃত্যশিল্পীরা বছরের পর বছর অনুশীলনের মাধ্যমে যে কলা রপ্ত করেন, নাটকের শিল্পীদের পক্ষে তা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুপম স্টেপিংয়ের মাধ্যমে টেমপেস্ট-এর অভিনেতারা কাহিনি বর্ণনায় অভিনবত্ব এনেছেন। বলা যায়, ঢাকা থিয়েটার নিরাভরণ ও সাবলীল এই প্রযোজনায় টেমপেস্ট-এর মধ্যে প্রাচীন ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। বিশ্বনন্দিত শেকসপিয়রীয় অভিনয়রীতি থেকে সরে এসে নতুন অভিনয়-আঙ্গিকের মাধ্যমে একটি অভিনব ও স্মরণীয় প্রযোজনা উপহার দিয়েছেন তাঁরা।
পুরো নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চের ভেতরে অর্ধবৃত্তাকারে বসেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের সামনেই ছিল পোশাক ও প্রপস্ রাখার রঙিন টিনের বাক্স ও বাদ্যযন্ত্র। তাঁরা কখনোই মঞ্চ ত্যাগ করেননি, কেবল নিজের স্থান থেকে উঠে এসে অভিনয় শেষ করে আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসেছেন। আর এর মাধ্যমে অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে একটি ধারাবাহিক সংযোগ তৈরি করা হয়েছে, যা প্রচলিত নাট্যধারায় অনুপস্থিত।
চন্দন চৌধুরী, কামাল বায়েজীদ ও সামিউন জাহান দোলার অভিনয়ে ক্যালিব্যান, স্টেফানো ও ট্রিংকিউলোর ত্রিমুখী কমেডি দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করে রেখেছিল যে, মে মাসের ঠান্ডা রাতেও দর্শক ও অভিনেতার মধ্যে একটি উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দর্শকেরা এক মুহূর্তের জন্যও কাহিনি থেকে বিচ্যুত হননি।
টেমপেস্ট-এ সংগীত পরিচালনা করেছেন শিমূল ইউসুফ। একই সঙ্গে তিনি অ্যারিয়েল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নীল পোশাক, গভীর কণ্ঠস্বর ও অনিন্দসুন্দর গানের মাধুর্যে মঞ্চে দেহহীন আত্মার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। অ্যালোনজো চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম, মিরান্ডা চরিত্রে এশা ইউসুফসহ নাটকটিতে বাংলাদেশের দক্ষ মঞ্চাভিনয় শিল্পীরা অভিনয় করেছেন।
ঢাকা থিয়েটারের দি টেমপেস্ট বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা না হলেও নাটকটি দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবলোকন করেছেন। নাটকে প্রোসপেরো নিজের স্বপ্নকে যেভাবে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, তা বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটেও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
আলতাফ শাহনেওয়াজ
জন ফার্নডন : লেখক, নাট্যকার, সুরকার, গীতিকার, লন্ডন।

No comments

Powered by Blogger.