সহজিয়া কড়চা-চৈত্রসংক্রান্তিতে একটি শিরোনামহীন লেখা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

যাঁরা ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, আদি মানব-মানবী হলেন আদম ও হাওয়া। যাঁরা বিজ্ঞান ছাড়া আর কোনো মতবাদকেই আমলে নেন না, বিশেষ করে মান্যবর চার্লস ডারউইনকে তাঁদের পয়গম্বর মনে করেন, তাঁরা বানর, গরিলা, শিম্পাঞ্জি অথবা উল্লুককে তাঁদের পূর্বপুরুষ মনে করতে সংকোচবোধ করেন না।


এই দুই পক্ষ বাংলাদেশের কোনো ছাত্র-যুব সংগঠনের নেতা-কর্মী নন যে তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস নিয়ে মারামারি করবেন অথবা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় লিপ্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে ঠাঁই নেবেন। যাঁর যাঁর বিশ্বাস নিয়ে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবেই বেঁচেবর্তে আছেন।
যদি আমরা আদি বাবা-মা আদম-হাওয়ারই বংশধর হয়ে থাকি, তা হলে তাঁদের দোষ-গুণ ও মৌলিক স্বভাব-চরিত্র আমাদের মধ্যে আজও প্রবাহিত হচ্ছে। যদি আমরা বানর, শিম্পাঞ্জি বা উল্লুকের বংশধরও হয়ে থাকি, তাহলে তাদের স্বভাবও আমাদের মধ্যে থাকবে—আমরা যত শিক্ষিত হই এবং পিএইচডি, ডিলিট এবং ডিএসসি ডিগ্রি নিয়ে থাকি না কেন। কোনো নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটির স্বভাবের সঙ্গে সেখানকার সবচেয়ে নিম্ন স্তরের মানুষেরও কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে মিল থাকে। ওটা প্রাণী হিসেবে মানুষের ডিএনএ বা জেনেটিকসের ব্যাপার: বংশগতিবিষয়ক বৈশিষ্ট্য বা জীবকোষের সংকেতসংক্রান্ত ব্যাপার।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ আজ অনেক অগ্রসর। তবে সে তার আদিম প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আদমের মতো অনভিজ্ঞ মানুষও যদি ঈভ বা হাওয়ার প্রতি প্রসক্তি বোধ করে থাকেন, আমাদের বাংলাদেশের উঠতি আদমসন্তানেরা কিশোরী ঈভ বা হাওয়াদের ধাওয়া করবে না কেন? তাদের ধাওয়া খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কেউ মরবে, কেউ গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলবে, কেউ কীটনাশক খেয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। এবং যাবে তো যাবে, তারা আমাদের সমগ্র জনগোষ্ঠীর চোখের সামনে দিয়েই চলে যাবে। গোটা সমাজ, রাষ্ট্র, শাসকশ্রেণী ও প্রশাসনের চোখে যেন দশ ইঞ্চি সিমেন্টের দেয়াল দেওয়া রয়েছে। তাই একালের অভাগিনী হাওয়াদের আত্মমৃত্যু দেখতে পাচ্ছে না কেউ। তাদের অপমৃত্যুর মিছিলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মুখ।
অন্যদিকে প্রতিদিন সভা-সমাবেশে ও গোলটেবিলে আমরা মানবতা মানবতা করছি। গঠন করছি বিশেষ আদালত ও ট্রাইব্যুনাল। ‘দ্রুত’ বিচারের ব্যাপারে আগ্রহ অপার। কিন্তু আমাদের মেয়েরা যে মরছে প্রতিদিন, সম্ভ্রম হারাচ্ছে সংখ্যাহীন, পড়াশোনা বন্ধ করে হাজার হাজার মেয়ে ঘরের মধ্যে বন্দী জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে, তাতে আমাদের কিছুমাত্র করুণার উদ্রেগ হচ্ছে না। অথচ পৃথিবীর পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে মাত্র একটি দেশেই একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারী শুধু বাংলাদেশেই—অন্য কোনো দেশে নয়। একই সঙ্গে নারীর সর্বোচ্চ ক্ষমতায়ন ও সর্বকালের সবচেয়ে বেশি নির্যাতন।
প্রতিটি জনগোষ্ঠীর কিছু অভিন্ন চারিত্রিক বা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য থাকে। ফরাসি জাতির বৈশিষ্ট্য এক রকম, ব্রিটিশদের বৈশিষ্ট্য অন্য রকম, আইরিশদের আলাদা, ইরানিদের আরেক রকম, বাঙালিদের অন্য রকম হতেই হবে। ওই অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বড়-ছোট বা ধনী-দরিদ্রের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার পক্ষের ও স্বাধীনতা-বিরোধীদের মধ্যে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে কিছু মিল থাকবেই। কারণ, তাদের বিশেষ ধরনের ডিএনএ। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রওশন ইজদানীর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার সাগরদের, অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে আমার মতো অধমেরও কিছু মিল থাকবেই।
জনগোষ্ঠীর যৌথ আচরণ সম্পর্কে পাশ্চাত্যে মনোবিজ্ঞানীরা প্রচুর গবেষণা করেছেন। মালেন (Mullen) গোয়েথাল্স এবং জর্জ গোয়েথাল্স সম্পাদিত Theories of group Behavior (নিউইয়র্ক, ১৯৮৭) এবং এসএল ওয়াশবার্ন এবং আর মূর-এর Ape into Man (বোস্টন, ১৯৭৩) প্রভৃতি বইতে সম্প্রদায়ের যৌথ আচরণগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সব শ্রেণীর বাঙালির একটি অভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো: সমাজকে কিছু না দিয়ে ফাঁকতালে যত বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছে। খ্যাতিমান লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকেরাও প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের তুলনায় রাজনীতিক ও আমলাদের অবদান খুবই কম। সাড়ে আট মাস বিদেশ-বিভূঁইয়ে তাঁরা অবশ্য অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। জনযুদ্ধের মধ্যে কলকাতার প্রবাসজীবনে অনেকে ভারত সরকার থেকে বেতন-ভাতা ও কাজের জন্য মাসোয়ারা পর্যন্ত পেয়েছেন। বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তারা ধর্মঘটের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। যার ফলে ভারত সরকারের কর্মকর্তারা তাজ্জব হয়ে গেছেন। আর তিন মাস মুক্তিযুদ্ধ চললে আমাদের প্রবাসী সরকারের কর্মকর্তারা ইনক্রিমেন্টের জন্য হয়তো আন্দোলন করতেন। এদিকে দেশের ভেতর ও সীমান্তে মানুষ জীবন দিয়েছে প্রতি ঘণ্টায়।
কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের পাওনার বেশি একটি টাকাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেন না। রাষ্ট্র তাঁদের স্বীকৃতি ও সম্মান দিলেই তাঁরা সন্তুষ্ট। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেল অন্য ব্যাপার। সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, বাড়তি দুটি ইনক্রিমেন্ট বাগিয়ে নিলেন। তাতে সিনিয়র, জুনিয়রদের মধ্যে যে বিবাদ ও বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, সে খেসারত জাতি দিয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই ’৭৫-পরবর্তী সরকারগুলোকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশ অকুণ্ঠ সমর্থন দেননি। যে মনোবৃত্তি থেকে যাঁরা দুটি ইনক্রিমেন্ট নিয়েছিলেন, সেই একই মনোবৃত্তি থেকে যাঁরা ইনক্রিমেন্ট পাননি তাঁরা সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়েছেন। কোন পক্ষকে দোষ দেব।
বছরে চার-পাঁচ টাকা জমির খাজনা মওকুফের জন্য কোনো দেশের মানুষ স্বাধীনতা চায় না। বিশেষ করে যে দেশে আশি ভাগ মানুষের ২৫ বিঘা তো দূরের কথা, আড়াই বিঘা জমিই নেই, সেখানে খাজনা মাফ জিনিসটা অতি ছোট ব্যাপার। মানুষ স্বাধীনতা চায় আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য। আত্ম-উন্নতির জন্য। জাতীয় সম্পদ সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সবাই ভোগ করার জন্য। স্বাধীনতার পর সাধারণ মানুষ অতীতের চেয়ে বেশি সংকটে পড়ল। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা পদ, প্রমোশন ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শাসক ও প্রশাসকদের মধ্যে লোভ-লালসার এমন বিশ্রী প্রকাশ ঘটল, যার তুলনা আফ্রিকার দু-একটি দেশে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
উঠতি বাঙালি মধ্য শ্রেণী ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের চাওয়ার শেষ নেই। বাড়ি, গাড়ি, জমির প্লটের বাইরেও তাদের আরও অনেক কিছু চাই। ৭ এপ্রিলের কোনো কোনো পত্রিকায় দেখলাম, সচিবেরা গাড়িতে পতাকা ব্যবহারের আবদার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এ আবদার আগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পর্যন্ত তাঁরা করেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর সুযোগ বুঝে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের কাছে বিপুল দাবি-দাওয়াসংবলিত এক স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। সাত্তার সাহেব ছিলেন পাকা বাদাম। তাঁকে ভাঙার সাধ্য আমলাদের ছিল না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থনে জেনারেল এরশাদই তাঁকে কাত করতে পারেন।
১৩ জুলাই ১৯৮১, ইত্তেফাক-এ ও অন্য কাগজে এক বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনটি দিয়েছিলেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে রাষ্ট্রপতির সমীপে ‘আপনার একান্ত অনুগত মফিজুর রহমান, সভাপতি’। বহু চাওয়ার মধ্যে সেখানে একটিতে ছিল: ‘সচিবদের ও সচিব পর্যায়ের অফিসারদের বিনা ভাড়ায় সরকারি বাড়ি ও গাড়ির সুবিধা দিতে হইবে—তাহাদের গাড়িতে বিশেষ পতাকা ব্যবহারের অনুমতিসহ সমান হারে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হইবে।’
তাদের যে সব দিতে হবে, সে তো মোরা জানি, মোদের যত বিত্ত প্রভু—মোদের যত সোনার খনি। কী তাঁদের দেওয়া হয়নি? একজন দক্ষ কর্মকর্তার পিএইচডি ডিগ্রির দরকার কি? পণ্ডিত বানাতে হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। বিদেশে এমএস-ডক্টরেট করতে পাঠানো প্রয়োজন শিক্ষকদের, কিন্তু আমরা দেদার পাঠাচ্ছি আমলাদের। বিদেশে সফর বেহেস্তে যাওয়ার চেয়ে বেশি উপভোগ্য। সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার তাঁরা করবেন না তো কে করবে?
পাকিস্তান আমল থেকেই হয়ে আসছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ আমলাদের ভাগ্য খুলে দেয়। আমলাদের দক্ষতা দরকার, পাণ্ডিত্য নয়। আমাদের সরকার আমলাদের পণ্ডিত বানানোর জন্য রাষ্ট্রের কোষাগারকে উজাড় করে দিয়েছে। কোনো কোনো পণ্ডিতি যে ষোলোআনাই মিছা, তা আমাদের রাষ্ট্র জানে না। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াদের জোট সরকারের আমলে এক হাজার ৪২৬ কোটি টাকার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় প্রশাসনকে পণ্ডিত বানিয়ে ‘গতিশীল’ করতে। ওই প্রকল্পের নাম সম্ভবত ‘চাকরির পরিকল্পনাগত কাঠামো’।
এক হাজার ৪২৬ কোটি টাকা যদি শিশুদের বই ছাপায় ব্যয় হতো, জাতি উপকৃত হতো। টাকাটা পানিতে গেল। কর্মকর্তাদের নামের আগে ‘ড.’ এবং গাড়িতে পতাকা লাগালে গরিব আত্মীয়স্বজন ও শ্বশুরবাড়িতে ছাড়া সচিবালয়েও যে তাঁদের মর্যাদা বাড়ছে, তা-ও নয়। কাগজে পড়লাম, তাঁদের ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ একজন বলছেন, তাঁদের গাড়িতে পতাকার স্ট্যান্ড খাড়া আছে, কিন্তু তাতে কোনো পতাকা নেই, যা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং বিচারকদের আছে।
এমন দিন সামনে আসছে, শুধু সচিব নন, উপজেলা চেয়ারম্যান নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নন, সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের গাড়িতেও পতাকা উড়বে। তাঁদের গাড়িতেই পতাকা ওড়া উচিত; যাতে বহু দূর থেকে দেখে জনগণ ও টেন্ডারওয়ালারা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারে। পতাকা আজ সবারই চাই, কারণ একটি পতাকার জন্যই তো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।
কর্মকর্তাদের চাওয়া যখন এতটা, জনপ্রতিনিধিরা আরও বেশি চাইলে বিস্ময়ের কিছু নেই। উপজেলা সদর থেকে উপজেলার যেকোনো দিকে ১০ মাইলের বেশি নয়। মোটরসাইকেলই সেখানকার উপযুক্ত যানবাহন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের মূল্যবান আনকোরা নতুন জিপের জোর দাবি শুরু থেকেই। কাজকর্ম কিছুই নেই, ঘুরে বেড়ানোর গাড়ি চাই। জুতসই পরিভাষা তৈরিতে বাঙালি দক্ষ। প্রশাসনের প্রশ্নে ‘গতিশীল’ কথাটা খুবই উচ্চারিত। যার চাকা আছে, তাই গতিশীল। চাকা আছে গাড়ির। সুতরাং আগে গাড়ি চাই। পরে কাজ। পাঠ্যবই ছাপার কাগজ আমদানির চেয়ে দামি গাড়ি আমদানি জরুরি।
বড় আমলা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-ক্যাডাররা হাটবাজার, নদীনালা, খালবিলের খাসজমি দখলে দক্ষতা দেখালে সংস্কৃতিজগতের লোকেরা বসে থাকেত পারেন না। উন্নততর আধুনিক জাতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টিতে আগ্রহ নয়, তাঁদেরও আগ্রহ জমিজমার দিকে। তাঁদের নীতি হলো, নিজে যদি ভোগ করতে না-ও পারি, অন্যকে ভোগ করতে দেব না। অর্পিত সম্পত্তিসংক্রান্ত অবিচার দূর করতে আমরা বছর ১২-১৪ আগে কাজ শুরু করি। কামাল লোহানী, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আমি ও আরও অনেকে সারা দেশ থেকে তথ্য জোগাড় করতে থাকি। ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে আমরা বসতাম। সিলেটের সিংহবাড়ির উত্তরাধিকারীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র আমরা ঠেকাতে চেষ্টা করি। ফরিদপুরসহ আরও অনেক জায়গায় উত্তরাধিকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাই। ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে বসে আছি। দুজন লোক এসে বললেন, পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি বেদখল হয়ে গেছে।
আমি অবাক হলাম। দেশত্যাগের আগেই তাঁদের পরিবার কলকাতায় স্থায়ীভাবে চলে যায়। সুচিত্রা সেন ফ্রক পরে পেয়ারা চিবোতে চিবোতে এক্কা-দোক্কা খেলা অবস্থায় কলকাতায় যান। কোনো দিন বাড়িঘরের কথা বলেননি। যেদিন কলকাতায় তাঁর বাড়ি ডেভেলপাররা ভাঙেন, সেদিন আমি কলকাতায় ছিলাম। বিষয়-সম্পত্তি কোনো কিছুর ওপরই তাঁর আগ্রহ নেই বহুকাল। মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মেডেল-ক্রেস্ট প্রভৃতি তিনি উঠানে ফেলে রেখে ভাড়াবাড়িতে গিয়ে ওঠেন। কাগজে তা নিয়ে লেখালেখি হয়। এত দিন পর তাঁর জন্মভিটেমাটি ও জমিজমা পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের কথা শুনে অবাক হই। ৬০ বছর তাঁর ভক্তরা কোথায় ছিলেন। তাঁর স্মৃতিরক্ষা করতে হলে তাঁর অভিনীত ছবি বেশি করে দেখা উচিত, যা আমি করি। তাঁর ফিল্ম নিয়ে আলোচনা হওয়াও দরকার। তাঁর বাপ-দাদার ভিটেমাটি নিয়ে হাহাকার করা নয়।
শুধু সুচিত্রা সেনই নন, নানা রকম ভিটেমাটি উদ্ধারের আয়োজন হচ্ছে নানা দিক থেকে। আমার কাছেও কেউ কেউ এসেছেন। তাঁদের ইচ্ছায় সায় দিতে পারি না বলে তাঁরা অসন্তুষ্ট হন। সত্যজিত্ রায় তাঁর ঠাকুরদার বাড়িঘর-জোতজমি নিয়ে কোনো দিন একটি কথাও বলেননি। সোয়া শ বছর পর এখন উপেনবাবুর সম্পত্তি বেহাত হওয়ার কথা শুনছি। ১০০ বছর পর কামিনী রায়, ৭০ বছর পর সুকান্তদের পৈতৃক ভিটা শুধু নয়, নজরুলের একাধিক শ্বশুরবাড়ি, রবীন্দ্রনাথের একমাত্র শ্বশুরের সয়সম্পত্তি নিয়ে এখন আমাদের সংস্কৃতিজগত্ মহাব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুবই যোগ্য মানুষ, কিন্তু অযোগ্য জামাই। শ্বশুরের সম্পত্তি রক্ষা করার যোগ্যতা তাঁর ছিল না। শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহির জামাই আদর তিনি কোনো দিন পাননি। গোটা রবীন্দ্র-সাহিত্যে দক্ষিণডিহি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এখন দক্ষিণডিহি শান্তিনিকেতনের চেয়েও বেশি বিখ্যাত হওয়ার পথে।
বহুকাল আগে স্বর্গত হিন্দু কবি-লেখকদের ভিটেমাটি পুনরুদ্ধারের জন্য একদল সেকুলার মুসলমান সেটেলমেন্ট অফিসে দলিল-পর্চা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। ওই স্বর্গবাসী লেখকেরা বিধেয় মাত্র, উদ্দেশ্য কোনো একটা কিছু করে মোড়লি করা এবং নামধাম করা। এখনো অমর্ত্য সেন বেঁচে আছেন। তাঁর উইল করে যাওয়া উচিত, তাঁর মৃত্যুর পর যেন পিতামহ সারদাপ্রসাদ সেন ও বাবা আশুতোষ সেনের স্মৃতিরক্ষার জন্য মানিকগঞ্জের কোনো পরিবার ভিটেমাটিছাড়া না হয়। ড. সেনের ভিটেমাটি নিয়ে যে কী পরিমাণ টানাটানি হবে, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। লারমিনি স্ট্রিটের মোড়ে এখনই গিয়ে আমাদের সংস্কৃতিসাধক ও স্মৃতি রক্ষাকারীরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন। অমর্ত্য সেন চোখটা বুজলে হয়। জ্যোতিবাবুর মৃত্যুর পর সে আলামত দেখা গেছে।
এখন আর শুধু মৃত্যুবার্ষিকীতে মন ভরে না, জন্মদিন পালনেরও হিড়িক পড়েছে। বিপদ পত্রিকার সম্পাদকদের। মনে আছে, সম্পাদক হিসেবে আমার কাছে প্রথম যে অনুরোধটি আসে, তা জন্মদিনসংক্রান্ত। এক বিত্তবান ভদ্রলোক এলেন এক দিন এক প্রেস রিলিজ নিয়ে। প্রায় ২০ বছর আগে তাঁর বাবা জান্নাতবাসী হয়েছেন। কিছু সমাজসেবা করে থাকবেন। তাঁর বংশধরকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রতিবছরই তাঁর জন্মদিন পালন করেন কি না। বললেন, না, এবারই করব। নির্বোধ ও লোভী মানুষকে কিছু বোঝানো যায় না। মহামানব ছাড়া কোনো মৃত মানুষের জন্মদিন দুনিয়ার কেউ উদ্যাপন করে না। গতবার এক গৌণ লেখক মারা যাওয়ার ১১ দিন পর তাঁর জন্মদিন পালনের আহ্বান এল পত্রিকায়। কুলখানি আর চেহলামের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মদিন। জীবদ্দশায় কেন তাঁর জন্মদিন হয়নি। লোভ, মর্যাদা, সম্মান ও খ্যাতি মানুষের গলায় গামছা দিয়ে আদায় করার প্রবৃত্তি। পত্রিকাগুলোর বার্তা সম্পাদক কঠোর না হলে এ প্রবণতা আরও বাড়বে।
মধ্যশ্রেণীর বাঙালির মন অন্যকে পেছনে ফেলে সামনে থাকতে চায়। অল্পস্বল্প কাজ করে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পদক-পুরস্কার বাগাতে তার জুড়ি নেই। সভা-সমাবেশে গিয়ে সমাজের উঠতি মানুষগুলো প্রথম সারির চেয়ারে বসার জন্য ব্যাকুল হন। যে যত সামান্য, ভালো আসনের জন্য তার তত ধাক্কাধাক্কি। গত কয়েক মাসে মঞ্চে বা সামনের সারিতে বসার আসন নিয়ে মারামারি করে বহু অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে। মাননীয় এমপি বা উপজেলা চেয়ারম্যানকে প্রধান অতিথি না করায় বহু ব্যক্তিকে এলাকা ছাড়তে হয়েছে ১৫ মাসে।
শুধু জীবিতদের ক্ষেত্রে নয়, মরহুম মধ্যবিত্তদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যোগ হয়েছে আরেক প্রবণতা। এখন উঠতিদের কেউ মারা গেলে জুরাইন, খিলগাঁও বা আজিমপুরে কবর দিতে চাইছে না। ওই সব গোরস্থানের কোনো মর্যাদা নেই। হয় বনানীতে, নয়তো মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে চিরকালের জন্য শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার বাবাকে বা শ্বশুরকে কবর দিলেন কোথায়?—মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের কবরস্থানের পাশেরটিতে। ছিলেন হয়তো শান্তি কমিটিতে।
জাতির মর্যাদা বাড়ানোর চেষ্টা না করে ব্যক্তিগত মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য বাঙালি আজ হন্যে হয়ে গেছে। এ সম্মান টেকসই হয় না। স্বভাবকবি গোবিন্দচন্দ্র দাস লিখেছেন: ‘বাঙ্গালী মানুষ যদি প্রেত কারে কয়?’ রবীন্দ্রনাথ অনেক ভদ্র: সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি। সব বাঙালি প্রেতও নয়, সবাই শুধু বাঙালিও নয়। চার সাততা আটাশ কোটির মধ্যে মানুষ এখনো আছেন। তাদের একটু সক্রিয় হওয়া দরকার। ডারউইনের কথামতো যদি আমরা বানর, গরিলা বা উল্লুকের বংশধরও হয়ে থাকি—এখন তো মানুষ!
১৪১৭ সবার জন্য শুভ হোক। বাংলা নববর্ষ সবার জন্য বয়ে আনুক অশেষ কল্যাণ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.