রক্ত ও তরবারির গান-জারদারির হাতে মুর্তজার রক্ত by ফাতিমা ভুট্টো

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি ফাতিমা ভুট্টোর আত্মজীবনীমূলক বই সঙস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড (রক্ত ও তরবারির গান) সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভুট্টো পরিবারের দ্বন্দ্ব-কলহ ও ক্ষমতার লড়াইয়ের পাশাপাশি পাকিস্তানি রাজনীতির চরিত্র উদ্ঘাটনের চেষ্টা রয়েছে।


বইটির কিছু নির্বাচিত ও পরিমার্জিত অংশ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে।

জুনম (নুসরাত ভুট্টো) যেদিন বিদেশ থেকে ফিরলেন, সেদিন জানলেন তাঁর আরেক ছেলেও নিহত (১৯৮৬ সালে প্যারিসে মারা যান ছোট ছেলে শাহনেওয়াজ)। আলঝেইমার-এ আক্রান্ত বলে বড় ছেলের হত্যার কথা আগে কেউ তাঁকে বলেননি। গাড়ি যখন ৭০ ক্লিফটনের কাছে পৌঁছাল, তখনই জানানো হলো। হেলিকপ্টারে লারকানায় যাওয়ার পথে তিনি শিয়াদের মতো বুক চাপড়ে মাতম ও শোক করতে থাকেন। এরপর তিনি আর সুস্থ হননি।
শোকের তৃতীয় দিনে রাতের আঁধারে বেনজির এলেন, যাতে প্রতিবাদকারীরা তাঁর গাড়িবহরে হামলা করতে না পারে। তিনি বললেন, মাকে কিছুদিন তাঁর কাছে রাখতে চান এবং তিনি আমাদের ঘরের বাইরে চলে গেলেন। আমরা আর দাদিকে দেখতে পাইনি। বেনজির কখনো আমাদের তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেননি।
বাবা মারা যাওয়ার ছয় মাস পর ইসলামাবাদে আমরা ৪০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়েছিলাম। দাদিকে মনে হলো ক্লান্ত, বেদনাহত ও বৃদ্ধ। তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। আমি জানি না কী জন্য। জুলফি (আমার ছোট ভাই) ও আমাকে দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন।
আমরা যখন ফুফুর কাছে সাক্ষাতের জন্য জোরাজুরি করলাম, তখন তিনি বললেন, তোমাদের মা এলে সাক্ষাত্ এখানেই শেষ। আমরা আমাদের দাদির সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না, তাঁর সঙ্গে দেখা করা কিংবা তাঁর সেবাযত্ন করার সুযোগ পেলাম না।
বাবার মৃত্যুর পর আমাদের ছোট ফুফু সনম ৭০ ক্লিফটনের মালিকানা নিয়ে আমার ও জুলফির নামে মামলা করলেন। জুলফি তখন নয় বছরের বালক আর আমি ১৮-তে পড়েছি। তিনি পাকিস্তানে আসেন সরকারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এবং বাবা, মা, আমার ভাই ও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষাৎকার দেন। আমি সানি ফুফুর অভাব বোধ করি। কত দিন তাঁকে দেখি না।
১৯৯৭ সালে আসিফ জারদারি, আবদুল্লাহ শাহ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। এখনো মামলাটি আদালতে ঝুলে আছে। দুর্নীতিগ্রস্ত আদালত ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জারদারির প্রভাবিত পাকিস্তানের আদালতে বিচার পাব কি না, সে ব্যাপারে সংশয় আছে। এ পর্যন্ত ১৬ বার এই মামলার বিচারক পরিবর্তন করা হয়েছে। সব সাক্ষ্য-সাবুদ নেওয়ার কিংবা তথ্য-প্রমাণ হাজির করার আগেই অভিযুক্তদের রেহাই দেওয়া হয়েছে।
সিন্ধু হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াহিউদ্দিন আহমদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ন্যায়বিচারের কোনো আশা আছে কি না। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এখন অবশ্যই নয়।’ ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর করাচির সেশন কোর্ট অভিযুক্ত সব পুলিশ সদস্যকে মুর্তজা ভুট্টো ও তাঁর ছয় সহযোগীকে হত্যা মামলা থেকে খালাস দেন।
এ রায় ঘোষণার এক মাস পর সাবেক রাষ্ট্রপতি ফারুক লেঘারি, যিনি বেনজিরের দ্বিতীয় সরকারকে বরখাস্ত করেছিলেন, দুনিয়া টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ‘বেনজিরের শাসনামলে একদিন শেষরাতে জারদারি আমার কাছে এসে বললেন, মুর্তজা ভুট্টোকে শেষ করে দিতে হবে। জারদারির কথা হলো, “হয় সে থাকবে, নয় আমি”।’
লেঘারি আরও বলেন, বেনজির ও তাঁর স্বামী দুজনই ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, হত্যার দায়মুক্ত হতে নানা চেষ্টা-তদবির করেছেন। লেঘারির দাবি, জারদারির হাতে মুর্তজার রক্ত লেগে আছে এবং আরও কতজনের আল্লাহই বলতে পারেন।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বেনজির ভুট্টোর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জারদারি ও আমি ফের কাছাকাছি আসি।
এটি ছিল নির্বাচনী মৌসুম। আমি লারকানায় ঘরে ঘরে মায়ের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলাম, তিনি পিপিপির সর্বময় কর্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। সেদিন বিকেলের কোনো একসময় মা আমাকে ডেকে বললেন, বেনজির আঘাত পেয়েছেন। তাঁরা বলাবলি করছিলেন সমাবেশে কিছু একটা ঘটেছে—তিনি বললেন।
আমি উপলব্ধি করলাম, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর (হত্যা) নয়। তিনি বেঁচে থাকুন সেটাই আমি চাই।
‘আমিও তাই মনে করি,’ মা বললেন।
মিনিট ৪০ পরে বাবার কর্মী কাদির আমরা যে বাড়িতে গিয়েছিলাম সেখানে ঢুকেই ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের বাড়িতে যাওয়া উচিত।’ আমি উচ্চ স্বরে বললাম, ‘না।’
কাদির আবারও বললেন, ‘বাড়িতে যাওয়াটাই আমাদের জন্য ভালো হবে।’
আমি গাড়িতে উঠে বসলাম এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দরজা বন্ধ করলাম। কাদির আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওয়াদিকে (বেনজির) হত্যা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন আমি তাঁকে এই নামে ডাকিনি। কাদির আমাকে গাড়ির মাঝখানে বসালেন, অপর দুজন জানালার দুই পাশে। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি তিনি কী করছেন। আমার মনোনিবেশ ছিল ওয়াদির প্রতি।
‘এটি অসম্ভব।’ কাদিরকে বললাম, ‘তারা আরেকজন ভুট্টোকে হত্যা করতে পারে না।’
কিন্তু কথাটি আমার কানে বাজতে থাকল। আমি আমার বাবার কথার প্রতিধ্বনি শুনলাম। ‘তারা আরেকজন ভুট্টোকে হত্যা করতে পারে না।’
কিন্তু তারা বেপরোয়া।
আমি জুলফি ও মাকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করি, তাঁরাও রাস্তায় ছিলেন, কিন্তু টেলিফোন বন্ধ ছিল। আমি সাবিনকে ফোন করলাম, তিনি মায়ের নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে দিনরাত কাজ করছিলেন। তাঁর লাইনও পাচ্ছিলাম না। আমার সংবিত্ ফিরে এল, ‘হ্যাঁ তারা আমাদের আরও কাউকে হত্যা করতে পারে।’ প্রতি দশকে জুলফিকার ও নুসরাতের কোনো না কোনো সন্তান খুন হচ্ছেন।
আল মুর্তজায় আমিই শেষে পৌঁছালাম। মা, জুলফি, মীর আলী ও সাবিন আগেই সেখানে গিয়েছেন। যখন আমি তাঁদের দেখলাম, গাড়ি থেকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। আমি আমার পরিবারের জন্য দুঃখিত হলাম। আমি আমার দেশের জন্য দুঃখিত হলাম। আমি জুলফিকারের জন্য দুঃখিত হলাম।
সেই রাতে আমি জারদারিকে দেখলাম, যখন বেনজিরের লাশ রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিয়ে আসা হলো গরহি খুদা বক্সে দাফন করার জন্য। মা, জুলফি ও আমি লারকানা থেকে নাওদেরোতে গাড়ি চালিয়ে গেলাম। বাড়িটি ছিল শাহনেওয়াজের। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বেনজির এটিকে তাঁর রাজনৈতিক দলের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন।
আরেক ভুট্টোর শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার যদি সাহস থাকে, তাহলে আসিফ সেখানে আসবেন—এ কথা ভেবে আমি অবাক হলাম। আমি ভাবতে থাকি, তিনি তাঁর (বেনজির) স্বামী, তাঁকে তো উপস্থিত থাকতেই হবে। আমি ভাবতে পারিনি যে তিনি আমাদের মুখ দেখাতে পারবেন এবং আমিও জানি না কীভাবে বিষয়টি নেব।
আগামীকাল: বাবার মৃত্যুর দিনেই তিনি শপথ নিলেন।
গ্রন্থনা ও ভাষান্তর: সোহরাব হাসান

No comments

Powered by Blogger.