অধিকার-পুলিশের ধর্ম ও অতি উৎসাহী পুলিশ by এ জেড এম আবদুল আলী

এ দেশের পুলিশ-দারোগাদের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই জানা আছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা দুর্জনকে পালন ও শিষ্টজনকে দমন করে থাকেন। এটাই তাঁদের ধর্ম। এর ব্যতিক্রম খুব বেশি একটা দেখা যায় না। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যারা সরাসরি পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন তাঁরা এর কিছুটা ব্যতিক্রম। তবে, নিচের থেকে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের সংস্পর্শে এসে এঁদের মধ্যে কিছু কর্মকর্তার অধঃপতনের খবরও আমাদের কানে মাঝে মাঝে আসে।
দিন কয়েক আগে খবরের কাগজে আমরা এক দারোগার অন্য রকমের ধর্মের কথা জানতে পেরেছি। তিনি মনে হচ্ছে, আক্ষরিক অর্থে ইসলাম ধর্মের একজন বড় খাদেম। ঘটনাটি এ রকম: রংপুরের একজন এএসপি এক সন্ধ্যায় সেখানে পার্ক চিড়িয়াখানা প্রভৃতি স্থানে হানা দিয়ে জনা বিশেক তরুণ-তরুণীকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারকৃতদের অপরাধ, সেখানে মেয়েরা বোরকা না পরে উপস্থিত হয়েছিল আর সেই বোরকা না-পরা মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছিল কয়েকজন ছেলে। এই অতি উৎসাহী দারোগার কথা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, উনি আসল কাজটি করেন কি না? অর্থাৎ চোর-ডাকাতের গ্রেপ্তারে কতটা উৎসাহী? যে উৎসাহ নিয়ে তিনি বোরকা না-পরা মেয়েদের পেছনে লাগেন, চোর-ডাকাতদের গ্রেপ্তারে তাঁর সে রকম উৎসাহ আছে কি?
দেশে হুজি, জেএমবি এবং প্রচ্ছন্ন তালেবানদের সবারই নজর হচ্ছে কীভাবে মেয়েদের শায়েস্তা করা যায়। এর ওপর আবার দারোগা সাহেবদেরও যদি একটা অতিরিক্ত ডিউটি হয় মেয়েদের বোরকা বা ঘোমটা পরানো তাহলে বেচারিদের অবস্থা কী হয় তা ভেবে দেখতে বলি পাঠকদের। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি, যখনই মার্শাল ল হয় তখনই রাস্তায় ছেলেদের বড় চুল কেটে দেওয়া এবং মেয়েদের মাথায় ঘোমটা দিতে বা বোরকা পরতে বাধ্য করার চেষ্টা শুরু হয়। তাদের চোখে ইসলাম মানেই হচ্ছে যত রকমভাবে সম্ভব মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করা। মেয়েদের এটা করতে হবে, মেয়েরা ওটা করতে পারবে না—এসব দেখাটাই যেন সে সময় সেনা, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকের একটা বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এ রকমটি হবে তা আমরা কোনো দিন কল্পনা করতে পারিনি। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্টের পর যে বাংলাদেশ আমরা দেখছি তা একাত্তরে যে বাংলাদেশের জন্য এ দেশের আপামর জনতা লড়েছিল তার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাঁর জীবনের পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা যথার্থই বলেছেন।
তবে সব কথার শেষ কথা, যেভাবেই হোক নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাড়ার বখাটে তরুণ থেকে শুরু করে বাড়িতে স্বামী-শ্বশুর সবারই কাজ হচ্ছে মেয়েদের শায়েস্তা করা। একশ্রেণীর মৌলবি সাহেব সর্বদা বলে থাকেন যে মেয়েদের বেশির ভাগই মৃত্যুর পরে দোজখে স্থান পাবে। অতএব এ পৃথিবীতেই যাতে তাদের নরকযন্ত্রণা ভোগ করাটা অভ্যাস করতে হয় সেটা প্রত্যেকেরই দেখা উচিত। রংপুর শহরের পুলিশের এএসপিও সেই কাজটিকে তাঁর দায়িত্ব হিসেবে ধরে নিয়েছেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর এই মহত্ কাজে বাদ সেধেছেন কিছু সাংবাদিক। দারোগা সাহেবের এই কর্মকাণ্ড খবরের কাগজে ছেপে দিয়ে এই সাংবাদিকেরা তাঁকে ইসলামের আদর্শ খাদেম হতে বাধা সৃষ্টি করেছেন। খবরটি দেখে ঢাকাতে কয়েকজন আইনজীবী হাইকোর্টে ওই দারোগার বিরুদ্ধে মামলা করে দেওয়াতে হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই কর্মকর্তাটিকে রংপুর থেকে প্রত্যাহার করতে। দারোগা সাহেবকে বলা হয়েছে, এপ্রিল মাসে একদিন হাইকোর্টের সামনে হাজির হতে।
সৌদি আরব, ইরান প্রভৃতি দেশে ধর্মের পুলিশ রয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে কেউ কোনো রকম কিছু করলে, তা যদি তাদের চোখে ইসলামবিরোধী মনে হয়, তবে তাকে বা তাদের শায়েস্তা করা। মনে হচ্ছে, এবার বাংলাদেশেও সে রকম কিছু পুলিশ-দারোগা এসে গেল। বলাবাহুল্য, তাদের নজর সব সময় নারীদের দিকেই থাকবে। এমনিতেই দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, ফতোয়ার অত্যাচারে নারীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার উপক্রম, তার ওপর যদি রংপুরের এএসপি সাহেবের মতো কিছু পুলিশ শহরের দিকে নজর দেয় তাহলে দেশটি নারীদের জন্য নরক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব এখনই সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আশা করি, আমাদের উচ্চ আদালত ওই দারোগা সাহেবকে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন।
কাগজে দেখলাম, দিল্লিতে এক সভায় বক্তৃতা দিতে এসে একজন লেখক বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে যথাযোগ্য নিরাপত্তা দিয়ে তসলিমা নাসরিনকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। জানি না, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কারও নজরে এই খবরটি পড়েছে কি না। কে জানে হয়তো দেশের মানুষ ভাবছেন, এমনিতেই নানা সমস্যা, তার ওপর আবার তসলিমাকে নিয়ে ঝামেলা কে করবে? তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দেশে যদি এই অবস্থা হয় ইসলামিক রিপাবলিকগুলোতে কী হয় তা চিন্তা করতেই কষ্ট হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আহমদিয়াদের বার্ষিক সম্মেলনে স্থানীয় খতমে নবুয়ত দল বাধা সৃষ্টি করাতে বেচারা আহমদিয়ারা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। পুলিশ উল্টো আহমদিয়াদের সাতটি শর্তে তাদের বার্ষিক সম্মেলন করতে দিয়েছে। শর্তগুলো দেখলেই বোঝা যাবে সেগুলোর বেশির ভাগই মানবাধিকারবিরোধী। যাই হোক, সম্মেলনের দিন ওই সব শর্ত মেনে সম্মেলন করার চেষ্টা করলেও পুলিশের এক দারোগা গিয়ে তাঁদের শাসিয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ মাইক বন্ধ করতে বাধ্য করেছে। তারা একটু ক্ষীণ আপত্তি করাতে দারোগা সাহেব বলেছেন, হয় তাঁর হুকুম মানবেন, না হয় তার ফলাফল ভোগ করবেন। ফলাফল, মানে হচ্ছে, ওই সব খতমে নবুয়তওয়ালাকে লেলিয়ে দেওয়া। এই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো আজ প্রায় এক শ বছর ধরে তাঁদের ধর্ম পালন করে আসছেন। এত দিন তাঁদের কোনো রকম অসুবিধা হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে তারা প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শান্তিপ্রিয় আহমদিয়াদের শায়েস্তা করা তাদের একটি বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিপূর্বে আহমদিয়াদের সমর্থনে লন্ডনের হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড এভবেরি দুবার ঢাকায় ঘুরে গেছেন। তিনি আহমদিয়াদের বক্সীবাজারের প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত কয়েকজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতও আহমদিয়াদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে কিছু সদস্য সৌদি আরব ও ইরানের মতো ধর্মের পুলিশ হয়ে উঠেছে। এই উৎসাহী দারোগাদের ঠেকাতে না পারলে আহমদিয়াদের নিস্তার নেই। নিস্তার পাবে না এ দেশের নারীসমাজও।
প্রবাসে বসবাসরত আমার দুই বন্ধু গত নির্বাচনের পর ঢাকাতে ঘুরে গিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে জামায়াতীরা পরাজিত হলেও দেশে যেভাবে ধর্মীয় চরমপন্থীদের অব্যাহত তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তাতে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। ওই দারোগাকে না হয় আপাতত কিছুদিনের জন্য বিরত রাখা গেল কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মের নামে উগ্রতার হাত থেকে কে বাঁচাবেন আমাদের নারীসমাজকে, কে রক্ষা করবেন আমাদের দেশের নিরীহ ধর্মপ্রাণ আহমদিয়াদের।
এ জেড এম আবদুল আলী: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.