স্মরণ-শমশেরনগর চা-বাগানের নীরা বাউরী by মুজিবুর রহমান

চা-শিল্পের প্রাণ হচ্ছে চা-বাগানের অবহেলিত-নিষ্পেষিত চা-শ্রমিকেরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়ে ও বৃষ্টিতে ভিজে পাহাড় ও টিলায় চা-বাগানে বিপজ্জনক অবস্থায় কাজ করে থাকেন চা-শ্রমিকেরা। কিন্তু চা-শ্রমিকদের ছিল না কাজের কোনো সময়সীমা।


দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ ও তার অতিরিক্ত সময় কাজের (ওভারটাইম) জন্য পারিশ্রমিকের দাবিতে ডানকান ব্রাদার্সের প্রধান চা-বাগান শমশেরনগরে চা-শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। চা-শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক সংঘ। ঘটনাকাল ১৩ এপ্রিল, ১৯৬৯ সাল।
শমশেরনগর চা-বাগানের সব নারী-পুরুষ চা-শ্রমিকেরা প্রথমে দাবি আদায়ে পাঞ্জাবি ম্যানেজার নিয়াজ খানের সঙ্গে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কয়েক দফা আলোচনা করে ব্যর্থ হন। পরে চা-বাগানের কারখানাসংলগ্ন ম্যানেজারের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করা হয়। এদিন আর কোনো শ্রমিক চা-পাতা তোলার (সংগ্রহ করা) কাজে যাননি। ব্যবস্থাপনা পরিষদ সব চা-শ্রমিককে কাজে যোগদানের তাগিদ দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু স্থানীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদের কথায় চা-শ্রমিকেরা রাজি না হয়ে ধর্মঘটে অনড় থাকেন। সকাল ১০টার দিকে ম্যানেজারের অফিসের সামনে বেশ কয়েকজন নারী চা-শ্রমিক অবস্থান নিয়ে ধর্মঘটে যোগ দেন। ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী চা-শ্রমিকেরা শমশেরনগর চা-বাগানের তৎকালীন ম্যানেজার নিয়াজ খান ও তাঁর অফিসের কর্মচারীদের অবরোধ করে করে রাখেন। এ অবস্থায় শমশেরনগর চা-বাগানের তৎকালীন ম্যানেজার নিয়াজ খান টেলিফোনে মৌলভীবাজারের মহকুমা প্রশাসকের সাহায্য চান। মৌলভীবাজার মহকুমা ও কমলগঞ্জ থানা থেকে কয়েকটি গাড়িতে করে পুলিশ এসে আন্দোলনরত চা-শ্রমিকদের সরাতে চেষ্টা করে। তাতেও আন্দোলনরত চা-শ্রমিকেরা অনড় থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনরত নারী চা-শ্রমিকদের মারধর এবং চা-শ্রমিকদের লাঠিপেটা শুরু করে। অন্যায়ভাবে নারী চা-শ্রমিকদের ওপর লাঠিপেটাসহ বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাঁদের আঘাত করতে থাকে পুলিশ। এ সময় ম্যানেজার নিয়াজ খানের কার্যালয়ের পিয়ন চা-শ্রমিক নীরা বাউরী পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। তখন পুলিশ খুব কাছ থেকে গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই নীরা বাউরী মারা যান এবং আহত হন বেশ কয়েকজন চা-শ্রমিক।
এ খবর আশপাশের সব চা-বাগানে ছড়িয়ে পড়লে চা-বাগানের আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। পুলিশ চা-শ্রমিকদের দমিয়ে রাখার জন্য চা-শ্রমিক সংঘের নেতা কমরেড মফিজ আলী, সীতারাম বর্মাসহ অনেক চা-শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে। এতে পুরো চা-শিল্প অস্থির হয়ে ওঠে। চা-বাগানের শ্রমিকেরা কাজে যোগদান না করে চা-বাগানভিত্তিক আন্দোলন শুরু করেন। আর নেতৃস্থানীয় চা-শ্রমিকেরা শমশেরনগরে আন্দোলনরত চা-শ্রমিকদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। ১৪ এপ্রিল সকালে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ চা-শ্রমিক মিছিল করে মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। একই সঙ্গে মৌলভীবাজার মহকুমা সদরে মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে হাজারো চা-শ্রমিকের আন্দোলনে মহকুমা সদর কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তখন বাধ্য হয়ে মহকুমা প্রশাসক গ্রেপ্তার হওয়া চা-শ্রমিকনেতা কমরেড মফিজ আলী, সীতারাম বর্মাসহ সব বন্দী চা-শ্রমিককে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। এক রক্তক্ষয়ী চা-শ্রমিক আন্দোলনে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নীরা বাউরীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে চা-শ্রমিকেরা দৈনিক কাজের সময়সীমা পেয়েছেন আট ঘণ্টা। এ ঘটনার দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ থেকে ২০০৮ সাল দীর্ঘ ৩৭ বছর বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের (লেবার হাউস) নেতৃত্বে ছিল রাজেন্দ্র প্রসাদ বুনার্জির পরিষদ। দীর্ঘ ৩৭ বছরে বুনার্জি বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নে তাঁর স্বজনদের নিয়ে একটি পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। একবারও নিপীড়িত-নিষ্পেষিত চা-শ্রমিকদের কল্যাণে কোনো ভূমিকা রাখেননি। আর তাই মোটামুটি একটি বড় ধরনের আন্দোলনে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন হলে ২০০৮ সালের নভেম্বরে বুনার্জির পরিষদের বিপর্যয় ঘটে। প্রতিবছর ১৩ এপ্রিল চা-ছাত্র-যুব পরিষদ একটি স্মরণসভা করে আর শহীদ নীরার স্বজনেরা নীরার স্মৃতিসৌধে পুষ্প অর্পণ করে থাকেন। শহীদ নীরার কথা এ দেশের অনেকের কাছে যেভাবে অজানা রয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে চা-বাগানের নতুন প্রজন্ম অনেকই জানে না নীরার আত্মদানের কথা।

No comments

Powered by Blogger.