জয়—দ্রব্যমূল্যের জয় by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

চোয়াল বাড়ছে বোয়ালের মতো। বড়-বড় চোয়ালে বড়-বড় কথার হাউইবাজি চোখ ধাঁধাচ্ছে, পেট ভরতে পারছে না। আর চোয়ালের দৈর্ঘ্য যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে তার সঙ্গে তাল রেখেই। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা না করে চোয়ালের ধার বাড়িয়ে, কথার তুবড়িতে চোখ ধাঁধানোর চেষ্টাই চলছে শুধু।

কার ‘বড়গলা’ সে প্রসঙ্গে যেতে চাই না—তবে এ কথা জানি গলা বড় হলে গলার জোরে মিথ্যাকে সত্য, সত্যকে মিথ্যা বানানোর চেষ্টা করা যায়। কিন্তু গ্রাম দেশে একটা প্রবচন আছে তা হলো—‘শব্দ ঢাকবা কেশে, গন্ধ ঢাকবা কিসে?’ অর্থাত্ জোরে কাশি দিয়ে অন্য শব্দকে আড়াল করা গেলেও সে শব্দ যদি দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী হয় তাহলে সেই গন্ধ ঢেকে রাখা যায় না। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি—বৃদ্ধি আর বৃদ্ধি এখন সেই গন্ধের চেয়েও প্রাণান্তকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য যত অপকৌশলই গ্রহণ করা হোক না কেন, মানুষ ক্ষুধার কথা ভুলতে পারছে না। অর্থনীতিবিদরা বাজারের এ অবস্থার জন্য ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি ও আমদানির অনিয়মকে দায়ী করেছেন। অর্থনীতিবিদদের পক্ষে সত্য কথা বলে ফেলা সম্ভব এবং সহজেই সম্ভব; কিন্তু সবাই কি তা বলতে পারেন? এই সিন্ডিকেটের কথাই ধরা যাক। এদের দৌরাত্ম্যে একদিকে যেমন চাষী বা উত্পাদনকারী উত্পাদন খরচ উঠানোর মতো মূল্যও পাচ্ছেন না, অন্যদিকে শহরের ক্রেতাসাধারণ নিত্যপণ্যের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে হাত পোড়াচ্ছেন মূল্যের আগুনে। অথচ এই দুই শ্রেণী মিলেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রক্ত প্রকাশ্য দিবালোকে যারা চুষে নিচ্ছে, তারা কাউকে না কাউকে ম্যানেজ করেই তো সে রক্ত হজম করছে! যাদের তারা ম্যানেজ করছে সেই ক্ষমতাধরদের পক্ষে কী সত্য কথা বলে ফেলাটা সম্ভব! সম্ভব নয় বলেই তো তারা নানাদিকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে বিচিত্র কাশি দিয়ে চলেছেন।
ড. আকবর আলি খান বলেছেন, ... ‘বাজার সিন্ডিকেটের কাছে চলে গেছে বললে লাভ হবে না। আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে’ (আমার দেশ, ২৭ ফেব্রুয়ারি)। তা ড. আকবর আলি খানের পক্ষে এ কথা বলা সহজ। উনি তো আর রাজনীতি করেন না! ওনাকে দল চালাতেও হয় না। দল চালাতে টাকা লাগে। আর টাকা আছে সিন্ডিকেটওয়ালাদের হাতে। সে টাকা জনগণের রক্তচুষে বা পকেট মেরে অর্জিত হলেও টাকার গায়ে তো আর তা লেখা থাকে না! একটি কৌতুক পাকিস্তান আমল থেকেই চালু আছে। কৌতুকটি এমন—‘বিশ্ব পুলিশ প্রধানদের এক কনফারেন্স হচ্ছে, সেখানে একটা প্রশ্ন উঠেছে—কোনো দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে, তার উত্স খুঁজে বের করতে সেই দেশের পুলিশের কত দিন লাগে? বিভিন্ন দেশের পুলিশ এক-একটা আনুমানিক সময় বলল। পাকিস্তানের পালা এলে তাদের প্রতিনিধি বললো—এক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না। সবাইতো হতবাক। তাদের অবস্থা দেখে পাকিস্তান প্রতিনিধি আবার বললো, ‘এতে অবাক হওয়ার কী আছে? আমরা তো আগে থেকেই জানি কোথায় কি ঘটবে! আমাদের সাহায্য ছাড়া কি কেউ কিছু ঘটাতে পারে?’ আমার মনে হয় বর্তমান বাজার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই কৌতুকের প্রযোজ্যতা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
২০০৬ থেকে ২০১০-এর শুরু—এই সোয়া তিন বছরেই শুয়ে পড়েছে দেশের বিত্তহীন থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এখন মৃত্যু পথযাত্রী। অক্সিজেন-স্যালাইন দেয়ারও কেউ নেই। যে বিরোধী দল তাদের হয়ে আওয়াজ তুলতে পারত, তাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে, বেগম জিয়ার বাড়ি, জিয়ার মাজার, বিমানবন্দর ইত্যাদি নিয়ে অশ্লীল কাশির কাঁসর বাজিয়ে। বিরোধী দলও জাতীয় সমস্যা ছেড়ে সেই কাঁসরের তালে তালে নাচছে। নাচতে হলে জনসমস্যার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নাচুন। অন্যথায় কাঁসরই আসর মাত্ করবে, আপনারা নন। বিরোধী দলের চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ভারতের সঙ্গে দাসত্ব চুক্তির বাস্তবায়ন—যে পথ তৈরি করে দিয়ে গেছে এ দেশের ‘লেন্দুপদর্জি’ অবৈধ জরুরি সরকারের নেপথ্য প্রধান কুশীলব। ভারত প্রসঙ্গের মহাভারত আজ থাক। দ্রব্যমূল্যের প্রসঙ্গটি, জাতীয় জীবনে—ভারতের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমানে বড়ই জ্বলন্ত। বাজারে আগুনের আরেকটি কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা চাঁদাবাজির সর্বকালের রেকর্ডভঙ্গ হওয়ার কথা বলেছেন। শোনা যায় ‘চান্দাবাজির ধান্ধা’ চলে একটা লম্বা ‘চেইন’-এ। ক্ষমতার অতি নিম্নপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত তার দৈর্ঘ্য।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘খাওয়া’ (... আপনারা একাই খাবেন?...) কথাটা কে চালু করেছিলেন তাও আজ তুলতে চাই না। তবে ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই যে ‘খাওয়া-খাওয়ির’ ঘেউড়ে-প্রতিযোগিতায় প্রবল গতি আসে, সে বিষয়ে এখন আর কারও সন্দেহ নেই। আমরা ঢাকায় যখন প্রতিটি ফুলকপি ৩০ টাকায় কিনছিলাম তখন এক কপি চাষী এক মণ কপি বিক্রি করে তিন কেজি চালের দামও পাননি—এমন খবর পত্রিকাতেই এসেছে। অর্থাত্ কপি চাষী কপি প্রতি এক টাকা মূল্যও পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। সেই কপি ঢাকার বাজারে ৩০ টাকায় পৌঁছতে কত ঘাটে কত চাঁদা দিতে হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। অবশ্য এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফা অর্জনের শৈল্পিক কৌশলও যুক্ত আছে। চাঁদা আদায় করা হয় জোর করে। জোর খাটাতে চাই ক্ষমতা। চাঁদাবাজি সব সময়ই ক্ষমতার সোনার ছেলেদের কীর্তি। এবারের সোনার ছেলেরা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর অনুরোধ-ক্ষোভ-অভিমান কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না। ক্ষমতার স্বাদপ্রাপ্ত মধ্যস্বত্বভোগী সবাই বেপরোয়া।
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতেও বলেছেন, দ্রব্যমূল্য অনেকটা কমিয়ে (?) এনেছেন। যদিও বাজার বলছে মোটা চালের কেজি ৩৪ টাকায় পৌঁছে গেছে, যা অবৈধ সরকারের আমল থেকেও ৮-১০ টাকা বেশি। আমি নিজে মিনিকেট কিনেছি সেই আমল থেকে ১০ টাকা বেশি দিয়ে ৪৫ টাকা কেজি দরে। ডাল ছেড়েছি। হলুদ-পেঁয়াজ-রসুন-আদাও বাধা মানছে না কারও। মাছ-মাংসের কথা না ভাবাই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ—আপনি নিজে হস্তক্ষেপ করুন। বিভিন্ন প্রতিনিধির বিচিত্র কাশিতে দ্রব্যমূল্যের গন্ধ ঢাকা পড়ছে না কিছুতেই। এই ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে জয়, দ্রব্যমূল্যের জয়; ক্ষয়, ক্ষমতার ক্ষয়—এটাই স্লোগান হয়ে দাঁড়াবে এক দিন।

No comments

Powered by Blogger.