গদ্যকার্টুন-সৃজনশীল প্রশ্ন সৃজনশীল উত্তর by আনিসুল হক

স্কুলের ছেলেমেয়েদের যেন মুখস্থ না করতে হয়, পরীক্ষায় যেন নকল না হয়, যেন প্রাইভেট টিউটরের পেছনে টাকা ও সময় ঢালতে না হয়, যেন শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকশিত ও চর্চিত হয়, সে জন্য একটা চমৎকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। তার নাম সৃজনশীল প্রশ্ন। একটা অনুচ্ছেদ শিক্ষার্থীদের সামনে দিয়ে দেওয়া হয়, এরপর বলা হয় উত্তর লিখো।


তো সম্প্রতি ঢাকার এক স্কুলে এক শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের এসো হে বৈশাখ গানটি পুরোটা লিখে ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেন। তারপর এই কবিতায় কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা লিখতে বলেন।
প্রশ্ন: নিচের গীতিকবিতাটি পড়ো এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে কবিতার তাৎপর্য আলোচনা করো।
এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।।

মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।।

ক্লাস টেনের একজন সৃজনশীল বালক এই প্রশ্নের উত্তরে লেখে:

‘এসো হে বৈশাখ, এসো। তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে। এর মধ্যে এক তাপসকে দেখলাম, তাঁর নাম ফজলে নূর তাপস, তাঁর এলাকাকে আবর্জনামুক্ত করার জন্য একটা বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে তাপস-এর নাম নিয়েছেন, আর তাপসও বৎসরের আবর্জনা দূর করার জন্য তাঁর নির্বাচনী এলাকাবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এই উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
‘তবে রবীন্দ্রনাথের সব কথা যেন আমরা আভিধানিক অর্থে না নিই। হাসপাতালের মুমূর্ষুদের যেন আমরা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করি। এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। মুমূর্ষুদের কেউ উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে না। তবে, হাসপাতালগুলোয় বিদ্যুৎ না থাকায় শুনতে পাই কোনো কিছুই কাজ করছে না, এমনকি অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্রও। সেটা হলে বিপদের কথা। মুমূর্ষুরা উড়ে না গেলেও তাদের প্রাণপাখি উড়ে যেতে পারে।
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা। এই এক বৎসরে অনেক গ্লানি আমাদের হালখাতায় জমা পড়েছে। আমাদের স্কুলগামী মেয়েরা বখাটের উত্ত্যক্ততা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই আত্মঘাতী হয়েছে। তিন বৎসরের শিশু হয়েছে অকথ্য নিপীড়নের শিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে নিরীহ মেধাবী শিক্ষার্থীরা। আর সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে চকচকে চাপাতি দা কুড়াল হাতে সরকারি ছাত্র যুব সংগঠনের কর্মীরা টেন্ডার দখলের মরণপণ লড়াইয়ে মত্ত, পরিণামে ঘটছে খুন জখম। এই সব গ্লানি দূর করতে হবে। এই জন্য জরাগ্রস্ত মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে। সে জন্য চাই অগ্নিস্নান। সেই আগুন হলো শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টিবাণের আগুন। সেই আগুন কেবল প্রশাসনের কঠোরতার আগুন নয়, এই আগুন রাজনৈতিক নির্দেশনার আগুন। যে নেতা টেন্ডারবাজির পেছনে জড়িত, তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, তাঁকে অগ্নিস্নান করাতেই হবে।
‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি—রবীন্দ্রনাথের এই চরণ বাঙালি গায় বটে, কিন্তু মর্মার্থ ভেবে দেখে না। শুধু পুরাতন কাসুন্দি নিয়া ঘাঁটাঘাঁটি করে। ভুলে যাওয়া গান অবশ্য লোকে ভুলেই গেছে, এটা যাওয়া না যাওয়ায় কিছুই যায় আসে না। এটা রবীন্দ্রনাথ মনে হচ্ছে শুধু ছন্দ মেলানোর জন্যই লিখেছেন। আর অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক কথাটার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যদি আমাদের ঘর্মবাষ্প যোগ করে দিতেন, তাহলে ব্যাপারটার মধ্যে একটা ভবিষ্যদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যেত। যে হারে বিদ্যুৎ যাচ্ছে, আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দেশে গরম পড়ছে, তাতে ঘাম শুকানোটাও খুব জরুরি।
‘রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, এটা রবীন্দ্রনাথ কেন বলেছেন, আমার ঠিক জানা নাই। তিনি হয়তো প্রথম আলো পত্রিকার রস+আলো ম্যাগাজিনের কথা ভেবে থাকতে পারেন। কবিরা অনেক সময় ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দেশে যখন বিদ্যুৎ নাই, পানি নাই, গ্যাস নাই; আছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, তখন যে রস+আলোর রসের আবেশ পাঠকদের জন্য বিরক্তির সূচনা করে থাকে, কবি হয়তো সেদিকটাতেই সম্পাদক মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবেন।
‘আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ, মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক কথাটা রবি বাবু হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বলে থাকবেন। সরকারি দলের ছেলেদের মধ্যে যারা দুষ্ট গরু, তাদের যেন প্রধানমন্ত্রী কোনো মায়া না দেখান, মায়ার কুজ্ঝটিজাল যেন তাকে জড়িয়ে না ধরে, তাদের বিরুদ্ধে যেন প্রলয়ের শাঁখ বাজান, কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে দেন, রবীন্দ্রনাথ সেই কথাই লিখে রেখে গেছেন।’
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.