যে অপশক্তি এখনও সক্রিয় by স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না এলে ক্ষমতার মদমত্ততার আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মাণ ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩১ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন?


তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রথম ক্ষণ থেকে জানতেন সংকটকালে সবচেয়ে বড় করে দেখা দেয় 'ভরসার অভাব'। অবিরাম সেই ভরসার পরিবেশ শেখ হাসিনা সৃষ্টি করে চলেছেন। প্রাচীনকালে 'অভয় প্রদান'কে সবচেয়ে বড় দান বলে বিবেচনা করা হতো


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার 'সভ্যতার সংকট'-এ লিখেছিলেন, 'আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্যি সত্যি আমাদের লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে দূর করার জন্য টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণের পর গণতন্ত্র ছিল সামরিক জান্তার পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপে। কিন্তু কে হবেন সেই পরিত্রাণকর্তা? অবশ্যই সেই পরিত্রাণকর্তার নাম 'শেখ হাসিনা'। পাঠকদের ৩১ বছর আগের কথা বলতে চাই। বাংলাদেশে এখন প্রয়াত জিয়াউর রহমানের প্রবল প্রতাপশালিতার কথা কেউ বলতে চান না। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না এলে ক্ষমতার মদমত্ততার আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মাণ ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩১ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায়, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার যথাযথ মূল্যায়ন করেছেন? তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার প্রথম ক্ষণ থেকে জানতেন সংকটকালে সবচেয়ে বড় করে দেখা দেয় 'ভরসার অভাব'। অবিরাম সেই ভরসার পরিবেশ শেখ হাসিনা সৃষ্টি করে চলেছেন। প্রাচীনকালে 'অভয় প্রদান'কে সবচেয়ে বড় দান বলে বিবেচনা করা হতো। এ জন্য নূর হোসেন শেখ হাসিনার ভরসায় বুকে-পিঠে লিখে ফেলতে পেরেছিল 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক; স্বৈরাচার নিপাত যাক'। যে কারণে গফরগাঁয়ের গরিব রিকশাওয়ালা হাসমত আলী শেখ হাসিনার জন্য জমি কিনে রেখে যায়।
১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা হয়েছিল, '... দীর্ঘ ছ'বছর বিদেশে অবস্থানের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সতরই মে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেন তাদের নেত্রীকে। মধ্যাহ্ন থেকে লক্ষাধিক মানুষ কুর্মিটোলা বিমানবন্দর এলাকায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করবে। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বিমানবন্দরে কোন নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি...।' ওই সময়কার সরকারি দৈনিক 'দৈনিক বাংলা' ১৮ মে (১৯৮১) শেখ হাসিনার বিমানবন্দর সংবর্ধনা সংবাদে উল্লেখ করেছিল, 'ঐ দিন কালবোশেখি ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ৬৫ মাইল। এবং এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে লাখো মানুষ শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখার জন্য রাস্তায় ছিল।' এসেই তিনি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রামের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি প্রথম থেকেই হোঁচট খেয়েছেন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো আগের সিদ্ধান্ত পরে নিয়েছেন; আবার অনেক পরের সিদ্ধান্ত আগে নিয়ে ফেলেছেন। বিকল্প পথের চিন্তা তিনি সবসময় করে রাখেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঝুঁকিও নিয়েছেন। দায়িত্বের আন্তঃনির্ভরতায় অগাধ বিশ্বাস এবং এই চিন্তাধারা শক্তি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো বাঁধাধরা তত্ত্বে নিজেকে তিনি আটকে রাখেননি। খোলা মনে, খোলা চোখে শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে সবকিছু তিনি যাচাই করে দেখেছেন আর সে সঙ্গে পুরনোকে ছাড়িয়ে নতুনের দিকে বাড়িয়েছেন তার হাত। বিশেষত, বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের কিসের সঙ্গে সম্পর্ক, কিসের অগ্রগতি বা পশ্চাদগতি তা শেখ হাসিনা বুঝেছেন। তার পারদর্শিতায় দেশের সাধারণ মানুষের অগ্রগতি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন। কিন্তু সমাজের বিজ্ঞজনরা সবসময় স্বীকৃতি দেননি। এখানেই একটি কৌতূহলোদ্দীপক দ্বান্দ্বিকতা দৃশ্যমান হয়। উদারনৈতিকতার যে ধারা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সূচনা করতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার মূল্যায়ন আমরা ক'জন করেছি? ১৯৮৩ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসনের দু'দিন পর স্বাধীনতা দিবসে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন_ 'বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবই করব।'
রাজনীতির প্রথম দিন থেকে শেখ হাসিনার মনে হয়েছিল_ আন্তর্জাতিক দিক থেকে বিশ্ব শান্তি আজকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। যেসব বিরাট সমস্যা ও বিরোধে আমরা জর্জর তার সমাধান চেষ্টাই সবচেয়ে জরুরি। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি, বিরামহীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের আবহাওয়া সৃজন_ এসবই তার গভীর ভালোবাসার ফসল। পাঠক একটু ভেবে দেখবেন_ নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করা যেতে পারে, কথাগুলো শেখ হাসিনার পক্ষে বাড়িয়ে বলা কি-না। সাড়ে তিন বছর সরকারের প্রধান থাকার পরও বিশ্বখ্যাত জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের মতে, শেখ হাসিনা এখন ৭৭ শতাংশ বাংলাদেশির সমর্থনপ্রাপ্ত। ১৯৩৫ সালে জর্জ গ্যালাপ এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন এবং ১৯৩৬ সালে তা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগাম বার্তা দিয়েছিল। সত্যি সত্যি গ্যালাপের জরিপের মতো করে ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আলফ্রেড লেনডনকে পরাজিত করেছিলেন।
আজ দেশে-বিদেশে রাজনীতি-সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রাধান্যের কথা বলেন ও লেখেন। তিনি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সব রাজনৈতিক আন্দোলন, তৎপরতা, প্রশংসা-নিন্দার লক্ষ্য এবং উপলক্ষ। বাংলাদেশে একটা প্রচলিত মতবাদ_ বাংলাদেশের মতো দেশে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকলে জনগণের জন্য করণীয় খুব একটা থাকে না। অথচ ক্ষমতা কিংবা ক্ষমতার বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন সবসময়ই তিনি জনগণের কথা বলেছেন। অতীতে পিতার বৃহৎ পরিপ্রেক্ষণিকায় আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি। সেখানে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে বিরাট স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। এরপর আর কেউ কালের সেই পরিপ্রেক্ষণিকায় উত্তীর্ণ হননি। শেখ হাসিনা এদিক দিয়ে পিতার দিকে অগ্রসরমান এবং সুদৃঢ়। অপরিসীম তার ধৈর্য এবং বীরত্ব তার বিরাট। তিনি নিকটবর্তী বর্তমানের প্রত্যক্ষগোচর, এখানে বড়র সঙ্গে ছোট, মূল্যবানের সঙ্গে অকিঞ্চিৎকর জড়িত হয়ে থাকে। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগের দিন পত্রিকায় সংবাদ ছিল_ 'শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি তাদের কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করেছে।' এই প্রতিরোধ কমিটির কুশীলব এবং উত্তরসূরিরা এখনও সক্রিয়। ১৯৮১ সালের ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজ উইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জীবনের ঝুঁকি আছে, এটা জেনেই তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন। পলিটিক্সেও আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে কখনও হারিয়ে ফেলেননি। সত্য যেখানে বিপজ্জনক সেখানে সত্যকে তিনি ভয় করেননি, মিথ্যা যেখানে সুবিধাজনক সেখানে তিনি সহায় করেননি মিথ্যাকে। আধুনিককালের চলমান পটের ওপর তিনি নিত্যকালের চিত্র রেখে যাচ্ছেন।

সুভাষ সিংহ রায় :রাজনৈতিক বিশ্লেষক
suvassingho@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.