জবাবদিহি-নির্বাচন কমিশনের জন্য অগ্নিপরীক্ষা by বদিউল আলম মজুমদার

সম্প্রতি প্রথম আলোতে (২৫ এপ্রিল ২০১২) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, আমাদের একজন মাননীয় সাংসদ এনামুল হক সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত রয়েছেন, যার ফলে তিনি সাংসদ হওয়ার এবং সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। দুদক তদন্ত করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে বিষয়টি পাঠিয়েছে।


এনামুল হকের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ হলো, রাজশাহীর কাটাখালীতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে (প্রথম আলো, ১৩ আগস্ট ২০১১)। এর আগে তাঁর মালিকানাধীন এনা প্রপার্টিজ লিমিটেড ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মধ্যে রাজশাহীতে বহুতল সিটি সেন্টার নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত হলে আইনত তিনি সাংসদ হওয়ার এবং সে পদে থাকার যোগ্য হবেন না।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২(ট) ধারা অনুযায়ী, ‘কোন ব্যক্তি (সংসদ) সদস্য হবার এবং সদস্য থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি... তিনি কোন সমবায় সমিতি এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তি ব্যতীত, সরকারকে পণ্য সরবরাহ করিবার জন্য বা সরকার কর্তৃক গৃহীত কোন চুক্তির বাস্তবায়ন বা সেবা কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য, তিনি তার নিজ নামে বা ট্রাস্টি হিসেবে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের নামে বা তার সুবিধার্থে বা তার উপলক্ষে বা কোন যৌথ হিন্দু পরিবারের সদস্য হিসেবে তার কোন অংশ বা স্বার্থ আছে এরূপ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে থাকেন।’
আইনের এ সুস্পস্ট বিধান সম্পর্কে যোগাযোগ করলে প্রথম আলোর প্রতিবেদককে এনামুল হক বলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী। সে জন্য আমি যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা করতে পারি। তাতে আইনগত কোনো সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি না।’ অর্থাৎ, সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করায় তিনি দোষের কিছু দেখেন না, যা সঠিক নয়।
সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা দোষের কিছু নয় বলে যখন এনামুল হক দাবি করেন, তখন তিনি ভুলে যান যে তিনি আমাদের জাতীয় সংসদের—যাকে ইংরেজিতে ‘হাউস অব দ্য পিপল’ বলা হয়—একজন সম্মানিত সদস্য। সারা বাংলাদেশে তাঁর মতো এমন বিরল মর্যাদার অধিকারী মাত্র ৩৫০ জন ব্যক্তি আছেন, যদিও সংরক্ষিত আসনের ৫০ জন পরোক্ষভাবে নির্বাচিত।
জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার জন্য অনেকগুলো যোগ্যতা থাকতে হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে এসব যোগ্যতার কথা বলা আছে। যেমন, কোনো ব্যক্তি অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত হলে, তিনি সাংসদ হওয়ার বা এ পদে থাকার যোগ্য হবেন না। একই অযোগ্যতা প্রযোজ্য হয়, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ, যা জাতীয় সংসদে পাস করা একটি আইন, সাংসদ হওয়ার ও থাকার যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিষয়টি আরও কঠোর করা হয়েছে। আইনটির ১২ ধারায় অতিরিক্ত ১৫টি যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিধান রয়েছে, যার একটি সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-সম্পর্কিত। এ ছাড়া আইনে ঋণ ও বিলখেলাপি ব্যক্তিকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
এনামুল হকের এ বিষয়টি জানার কথা। কারণ, আইনটি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছিল এবং তিনি এ অধ্যাদেশের অধীনে নির্বাচন করে সাংসদ হয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করার জন্য এনামুল হককে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে এটির পক্ষে ভোট দিতে হয়েছে। প্রসঙ্গত, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে অযোগ্যতার বিধানটি নতুন নয়, এটি মূল আইনে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এ ছাড়া এনামুল হকের সংসদ সদস্য পদে থাকার অযোগ্যতা সম্পর্কে প্রথম আলোয় অন্তত দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। যেমন, ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘আইন ভেঙে সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য’। এ ছাড়া আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা আইন অমান্য করার যুক্তি হতে পারে না, বিশেষত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যখন একজন আইনপ্রণেতা।
আইনের এ বিধানের যৌক্তিকতা হলো, স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন করা। একজন সাংসদকে অনেক জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংসদে আলোচনা করতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয়। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যাতে ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যেই এমন আইনি বিধান। তিনি যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হন এবং সংসদ সদস্য পদ ও এর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান না হন। অর্থাৎ, আগারটা যিনি খান, গোড়ারটাও যাতে তাঁর খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না হয়, সে জন্যই এ ব্যবস্থা।
আইনপ্রণেতাদের পক্ষ থেকে ব্যক্তিস্বার্থদুষ্ট আচরণ একটি গুরুতর অপরাধ এবং অনেক দেশেই এ অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় লোকসভা থেকে যে ব্যক্তিটিকে প্রথম ‘এক্সপেল’ বা বহিষ্কার করা হয়, তাঁর অপরাধ ছিল তিনি স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছিলেন। এইচ জি মুডগাল নামের এই ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে লোকসভায় প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। এ অপরাধে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর উত্থাপিত প্রস্তাবে তাঁকে ১৯৫১ সালে লোকসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রসঙ্গত, বিতর্কিত ও দুর্নীতিমূলক আচরণের মাধ্যমে জনসম্মুখে সংসদের মর্যাদাহানি বা সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন করার অপরাধে—যাকে সংসদ অবমাননা বলে আখ্যায়িত করা হয়—ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে এ পর্যন্ত বহু সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়, আমাদের বেলায় যার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। যেমন, ২০০৫ সালে ১১ জন ভারতীয় সাংসদকে একযোগে বহিষ্কার করা হয়।
জনাব এনামুল হকের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কীভাবে সাংসদদের প্রভাবিত, এমনকি অন্ধ করে ফেলতে পারে তা তাঁর জানার কথা। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের আগ পর্যন্তও তিনি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ওই কমিটির সদস্য হিসেবে গৃহায়ণ খাত এবং রাজউক সম্পর্কিত অনেক সিদ্ধান্তকেই তাঁর প্রভাবান্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকেরই স্মরণ আছে, গত বছরের সেই সভার কথা, যেখানে আবাসন ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীকে নাজেহাল করার চেষ্টা করেছিলেন। সাংসদ ও সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সদস্য হয়েও জনাব এনামুল হক সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে। এটিই স্বার্থের দ্বন্দ্বের দুষ্ট প্রভাব।
জনাব এনামুল হকের স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়ে আরেকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। প্রায় দুই বছর আগে সংবাদপত্রে হেডলাইন হয়েছিল: ‘রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে ব্যাখ্যা চাইবে সংসদীয় কমিটি’ (আমাদের সময়, ৬ জুলাই ২০১০)। কমিটির মতে, সাংসদদের সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য প্রদান ছিল রাজউক চেয়ারম্যানের ‘অপরাধ’।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩০ জুন ২০১০ তারিখে ব্লাস্ট আয়োজিত এক সভায় রাজউকের চেয়ারম্যান বলেন, পরিকল্পিত পরিবেশ ও বাসোপযোগী ঢাকা চাইলে ড্যাপ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিগত স্বার্থে এর বিরোধিতা করছে। তারা ড্যাপ চায় না; রাজউককেও তারা তুলে দিতে চাইছে। তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়িত হলে কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। এই শহর কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হবে। যেসব সাংসদ আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সংসদে ড্যাপের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিয়েছেন। এ অবস্থায় ‘এ দেশে কে কী করবে? একজন সাংসদ গুলশান এলাকায় ছয়তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে ১৬ তলা করেছেন’ (প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০১০)। নিঃসন্দেহে এগুলো ছিল ঢাকাবাসীর মনের কথা। প্রসঙ্গত, জনাব হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে জনাব এনামুল হকসহ একাধিক আবাসন ব্যবসায়ী সদস্য ছিলেন।
উল্লেখ্য, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে আবাসন ব্যবসায়ীদের সদস্য হওয়া ছিল সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত ‘জাতীয় সংসদ কার্যপ্রণালী বিধি’র সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কার্যপ্রণালী বিধির ১৮৮(২) অনুযায়ী, ‘এমন কোন সদস্য (সংসদীয়) কমিটিতে নিযুক্ত হইবেন না, যাহার ব্যক্তিগত, আর্থিক ও পরোক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হইতে পারে এমন বিষয়ের সহিত সংশ্লিষ্ট আছে।’
এটি সুস্পষ্ট, জনাব এনামুল হক আইনানুগভাবে সাংসদ হওয়ার এবং থাকার অযোগ্য। আমাদের সংবিধানের ৬৫(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব কমিশনের এবং অনুরূপ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আশা করি, কমিশন দ্রুত তাঁর সংসদ সদস্য পদ খারিজ করার উদ্যোগ নেবে। প্রসঙ্গত, জনাব হক ছাড়া আরও কিছু সদস্য আছেন, যাঁরা নামে-বেনামে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ে লিপ্ত আছেন কিংবা সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ফির বিনিময়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন অথবা অন্যভাবে সাংসদ হিসেবে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কমিশনের জন্য এখন অগ্নিপরীক্ষার সমতুল্য। তবে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যাঁরা আইনভঙ্গকারী হয়েছেন, তাঁদের এ বেআইনি কাজ থেকে বিরত রাখার নৈতিক দায়িত্ব মাননীয় সংসদ নেতা ও মাননীয় স্পিকারও এড়াতে পারেন না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

No comments

Powered by Blogger.