পানিসম্পদ-হাওর মহাপরিকল্পনা ও হাওরবাসীর স্বপ্ন by ফারহাত জাহান

বিস্তীর্ণ আবাদি জমি বালির স্তর বৃদ্ধির কারণে পরিণত হচ্ছে পতিত জমিতে, নদী হারাচ্ছে অতিদ্রুত নাব্যতা, কিছু হাওর চিরতরে হারিয়েছে বালির গহ্বরে। হাওর মহাপরিকল্পনায় এ হাওর জীবন বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি। এ প্রাকৃতিক আন্তঃসম্পর্কের প্রতিফলন এ মহাপরিকল্পনা থাকা খুবই জরুরি ছিল হাওর বাংলার এক অনন্য জলাভূমি, প্রাচুর্য ও প্রান্তিকীকরণের দ্বৈরথে যার অবস্থান।


দশকের পর দশক ধরে হাওরবাসী সংগ্রামরত হাওরের ভূপ্রাকৃতিক স্বাতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠা ও একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য। গত ৪ মে ২০১২ হাওর মহাপরিকল্পনা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন। কী আছে সে মহাপরিকল্পনায়? হাওর রক্ষণার্থে ও হাওরবাসীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্যই হাওর মহাপরিকল্পনার অবতারণা।
হাওর মহাপরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ। ভিশন-২০২১ মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার যে স্বপ্নের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় হাওর মহাপরিকল্পনা তা এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ মহাপরিকল্পনায় ছয় স্তরবিশিষ্ট বাস্তবায়ন পদ্ধতির প্রস্তাবনা রয়েছে। প্রথম স্তরে বিদ্যমান নীতিমালা, পরিকল্পনা ও কৌশলের পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ নির্দেশনা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় স্তরে বিষয়ভিত্তিক ইস্যু ও সমস্যা চিহ্নিত করা হবে এবং জনমত বিনিময় সভার মাধ্যমে স্থানীয় দাবির আলোকে সম্ভাব্য সমাধান সামনে নিয়ে আসা হবে। তৃতীয় স্তরে অতীত ও চলমান উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর পর্যালোচনার মাধ্যমে তাদের অর্জন এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে। চতুর্থ স্তরে প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের সম্ভাব্যতা এবং ব্যবধান বিশ্লেষণ করা হবে। পঞ্চম স্তরে বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাবনার আলোকে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করা হবে। সর্বশেষ স্তরে নির্ধারিত কৌশলের আলোকে বিভাগ বা সেক্টরভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হবে।
হাওর সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়ার জন্য হাওর মহাপরিকল্পনা একটি চমৎকার সংকলন। হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি হাওরের জন্য একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, হাওরের জন্য বিশেষ উন্নয়ন বরাদ্দ ও হাওরকে একটি বিশেষ অঞ্চল ঘোষণা করা। আর সরকার কর্তৃক হাওর মহাপরিকল্পনার উদ্যোগের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলের গুরুত্ব জাতীয় পরিকল্পনা প্রকাশ পেয়েছে। আমরা সে উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ মহাপরিকল্পনা কি একটি হাওরবাসীর সম্যক উন্নয়ন দলিলে পরিণত হতে পেরেছে? এটাকে কি হাওর উন্নয়নের সামগ্রিক মহাপরিকল্পনা বলা যায়? এখানে কি হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে উঠে আসা দাবিগুলোর প্রতিফলন ঘটেছে?
মহাপরিকল্পনার দিকে ফিরে তাকালে দেখি ১৪৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে একটি হলো মুক্তা চাষ প্রকল্প, যা হাওর জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে একেবারেই নতুন। হাওরের বিশাল জলাভূমির বিস্তৃত সম্পদ 'মৎস্য-পাথর-ধান'-এর যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা বেশি জরুরি। মহাপরিকল্পনার ঢ়যুংরপধষ ংবঃঃরহম অংশে আন্তঃরাষ্ট্রিক নদী ব্যবস্থা আলোচিত হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে, হাওরাঞ্চল আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অংশের নিম্নে অবস্থান করছে। আর হাওরাঞ্চলের তিন প্রধান আন্তঃনদী প্রবাহ হলো মেঘালয়, বরাক ও ত্রিপুরা থেকে আসা প্রবাহ। এসব নদী হাওর এলাকায় ৪৬,১০৩ কিলোমিটার জুড়ে প্রবহমান। বরাক, মেঘালয় ও ত্রিপুরা নদী ব্যবস্থাপনা হাওরের আকস্মিক বন্যার জন্য দায়ী (হাওর মহাপরিকল্পনা, পৃ. ৭৫-৭৮)। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, হাওর উন্নয়নের জন্য যে ১৪৮টি প্রকল্পের প্রস্তাবনা করা হয়েছে সেখানে আন্তঃরাষ্ট্রিক নদীপ্রবাহের গতিধারা, পানির ন্যায্য হিস্যা ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত সুরমা-কুশিয়ারা প্রবহমানতা নিয়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা পরিকল্পনা নেই।
মহাপরিকল্পনার মহাদলিলে হাওর সম্পর্কিত সকল নীতিমালাই আলোচিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বহুমাত্রিক পরিবেশ চুক্তির আওতায় রামসার ও বায়ো ডাইভারসিটি কনভেনশনের সম্পৃক্ততাও স্থান পেয়েছে। কিন্তু যৌথ নদী কমিশনের সম্পর্ক ও আন্তঃরাষ্ট্রিক পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে মহাপরিকল্পনা নিশ্চুপ! অথচ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নদীগুলোর জলের হিস্যার ন্যাযতা ছাড়া হাওর হবে বিপন্ন। স্থায়িত্বশীল ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় এটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হওয়া দরকার। মহাপরিকল্পনায় কৃষি উন্নয়ন ক্ষেত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে; কিন্তু এখানে স্থানীয় ও ঐতিহ্যবাহী কৃষি সংরক্ষণের কোনো প্রকল্প প্রস্তাবনা নেই। একটি হাওর কৃষি ব্যাংক বা হাওর কৃষকের জন্য বিশেষ ঋণ ব্যবস্থাপনার দাবি হাওরবাসীর দীর্ঘদিনের চাওয়া, যার প্রতিফলন ঘটেনি এ মহাপরিকল্পনায়। পানি ও মৎস্যসম্পদ 'ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ধৎবধ্থ হাওরবাসীর দীর্ঘ তিন দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের দাবি 'ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার চাই'-এর স্বীকৃতি উঠে আসেনি মহাপরিকল্পনার কোথাও। 'ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার' কেবল দাবিই নয় এর সঙ্গে জনগণের সামাজিক ও প্রথাগত সম্পত্তির অধিকার এবং প্রাকৃতিক সম্পদে অধিকারের প্রশ্নটিও জড়িত।
ছয় স্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। ৩০টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন, ৬৯টি উপজেলায় জনমত বিনিময় সভা, ১৪টি র‌্যাপিড রুরাল অ্যাপরাইজালসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনাসহ দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এ মহাপরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জের সুশীল সমাজ এ মহাপরিকল্পনায় কোনো মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেনি বলে জানিয়েছেন। হাওরের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে 'টিপাইমুখ বিতর্ক'। বাংলাদেশের উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তা বহুবার আলোচিত হয়েছে; কিন্তু আলোচিত হয়নি এ মহাপরিকল্পনায়! অথচ সুরমা-কুশিয়ারা জলধারার প্রবহমানতা এর বাস্তবায়নের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। অন্যদিকে সীমান্তে অবাধে বন উজাড়, খনিজ উত্তোলন বাড়িয়েছে পাহাড় ধসের মাত্রা, বাড়িয়েছে বালির অনুপ্রবেশ। বিস্তীর্ণ আবাদি জমি বালির স্তর বৃদ্ধির কারণে পরিণত হচ্ছে পতিত জমিতে, নদী হারাচ্ছে অতিদ্রুত নাব্যতা, কিছু হাওর চিরতরে হারিয়েছে বালির গহ্বরে। হাওর মহাপরিকল্পনায় এ হাওর জীবন বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেনি। এ প্রাকৃতিক আন্তঃসম্পর্কের প্রতিফলন এ মহাপরিকল্পনা থাকা খুবই জরুরি ছিল।
যদিও মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে হাওরের গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু উপেক্ষিত হয়েছে হাওরবাসীর প্রাণের দাবিগুলো, দীর্ঘ সংগ্রামের দাবিগুলো। তবে অবশ্যই মহাপরিকল্পনার দিকে ঘুরে তাকাবার প্রয়োজন ছিল; প্রয়োজন ছিল হাওরবাসীর জীবন-জীবিকার দাবিগুলোর অন্তর্ভুক্ত করার।

ফারহাত জাহান :গবেষক
farhat718@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.