শ্রদ্ধাঞ্জলি-শিল্পী আমিনুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা by সমরজিৎ রায় চৌধুরী

শিল্পকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যে ক'জন আমাদের মাঝে উন্মুক্ত করেছিলেন অমিত সম্ভাবনার দুয়ার, শিল্পী আমিনুল ইসলাম নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। জীবনের শেষদিকে অনেক দিন রোগে ভুগেছেন তিনি। তবে তিনি বরাবর নিজের সম্পর্কে কম কথা বলতেন


শিল্পী আমিনুল ইসলাম, আমাদের আমিনুল ভাই আর এই পৃথিবীতে নেই_ এ কথা ভাবতে পারছি না। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর তেমন কিছু আর ভাবতে পারিনি আমি। চিন্তার মাঝে যেন এক প্রকার শূন্যতা তৈরি হয়েছিল আমার। শেষবারের জন্য তাঁকে দেখতে ছুটে গেছি চারুকলায়, তাঁর আপন ঘরে।
শিল্পী আমিনুল ইসলাম ছিলেন আর্ট কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। আমি যখন চারুকলার তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন তিনি ইতালি গেলেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য। পরবর্তী সময়ে ফিরে এসে চারুকলায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর আমিও শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই চারুকলায়। পরে তাঁকে আমি আমার সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি। বয়সের কারণেই হয়তো, বলা যায় তাঁকে খানিকটা ভয়ই পেতাম।
আমাদের কাজের ক্ষেত্র অবশ্য ভিন্ন ছিল। তিনি ছিলেন ড্রইংপেইন্টিংয়ে। আমি ছিলাম গ্রাফিক্স ডিজাইনে। আমিনুল ভাইয়ের মধ্যে বরাবর একাগ্রতা দেখেছি আমি। একনিষ্ঠ-তন্ময়প্রায় একাগ্রতা। হয়তো বড় শিল্পীরা এমনই একাগ্র হন। আর হন বিনয়ী, ঠিক আমিনুল ভাইয়ের মতো।
বছর পাঁচ-ছয় আগে আমরা বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন শিল্পী কলকাতা গিয়েছিলাম একটা ওয়ার্কশপে যোগ দেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে আমিনুল ভাইয়ের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছিল। শিল্পী হিসেবে আমিনুল ইসলাম যতটা বড়মাপের ছিলেন, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন অনেক উদার মনের। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রধান দুটি ঘটনা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ। তিনি দুটি ঘটনার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন।
শিল্পী আমিনুল ইসলাম নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ছবি আঁকার বিষয়বস্তুতে তিনি নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরি করেছিলেন। প্রথমদিকে তিনি বেশ কিছু অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ করেছিলেন। মাঝখানে তাঁর কাজে আমরা দেখি ফিগারেটিভ বৈচিত্র্য, যা সে সময় আমাকে আনন্দ দিয়েছিল। শেষের দিকে লাইন দিয়ে ছন্দোময় কাজ করেছিলেন। রঙের অদ্ভুত রেখার মাঝে যেন জীবনের আনন্দ-বেদনার বিভিন্ন দিক ফুটে উঠত।
হাসিখুশি খোলামনের এ মানুষটির শিল্পকুশলতা এদেশের চিত্রশিল্পেরই বড় এক অধ্যায়।
শিল্পকে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যে ক'জন আমাদের মাঝে উন্মুক্ত করেছিলেন অমিত সম্ভাবনার দুয়ার, শিল্পী আমিনুল ইসলাম নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। জীবনের শেষদিকে অনেক দিন রোগে ভুগেছেন তিনি। তবে তিনি বরাবর নিজের সম্পর্কে কম কথা বলতেন, নিজের সমস্যার কথা কখনও বলতে চাইতেন না। এত প্রচারবিমুখ মানুষ আমি জীবনে কমই দেখেছি।
দেশে ও বিদেশে আমিনুল ইসলামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পাওয়ার চিত্র যদি আমরা দেখি, তাহলেই বুঝতে পারব শিল্পী হিসেবে তিনি কতটা উঁচু স্তরের ছিলেন। ১৯৫৭ সালের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে তেহরানে গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল প্রাইজ, ১৯৮১ সালে একুশে পদক, ১৯৮৫ সালে স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার তিনি পেয়েছেন।
আমাদের এ অঞ্চলের চিত্রশিল্পকে বুঝতে হলে অবশ্যই আমিনুল ইসলামকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে চিত্রকলার সূত্রপাত করেন ঠিকই; কিন্তু চিত্রশিল্পে আধুনিকতার প্রলেপ প্রথম যাদের হাতে আসে আমিনুল ইসলাম তাঁদের অন্যতম। আমরা যারা তাঁর অনুজ, তাদের কাজের অন্তহীন এক অনুপ্রেরণা তিনি। বর্তমান ও আগামীর শিল্পীরাও আমিনুল ইসলামের সেই প্রদর্শিত পথের অনুসারী হবে।
আমিনুল ইসলামের কাজের ভাষায় যে নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছিল ইতালি থেকে ফিরে আসার পর, সে ধারা তখন কলকাতাতেও শুরু হয়নি। সে সময় কলকাতায় প্রাচ্যরীতির ওপর কাজ হতো। আর আমাদের শিল্পকলা তাঁর হাত ধরে আধুনিক জগতে প্রবেশ করে।
শুধু শিল্পই নয়, প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রেও আমিনুল ইসলাম ছিলেন তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে প্রথম সারির অন্তর্গত। চিন্তার ক্ষেত্রে, আধুনিকতার ক্ষেত্রে, প্রগতির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রগামী, সেই সময়ে ফর্ম, স্পেস, রঙের কম্পোজিশনের যে কাজ আমাদের উপহার দিয়েছেন, এক কথায় তা সবার জন্য ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথাগত ধারণায় আবদ্ধ না থেকে নতুন চিন্তায় ও কাজে তিনি এক নবযুগের সূচনা করেছেন আমাদের শিল্পাঙ্গনে। তাঁকে আমরা স্বর্ণযুগের শিল্পী বললেও কম বলা হবে।
শিল্পী আমিনুল ইসলাম আর বেঁচে নেই। কিন্তু তিনি মরেও যেন অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে, শিল্পের গভীর আলোছায়ার মাঝে। বাংলাদেশের চিত্রশিল্প যতদিন বেঁচে থাকবে, আমিনুল ইসলামের কর্ম ও প্রয়াস চির অম্লান থাকবে।
এ মহান শিল্পীর প্রতি আমার, আমাদের, সবার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য, তাঁর শূন্যতা পূরণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়; তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর রেখে যাওয়া কাজের মাঝে। তারপরও মন তো মানে না। জানি, এই মর্ত্যজগৎ অনিত্য; আমিনুল ভাই আপনি চলে গেছেন রঙ-তুলি-কাগজ নিয়ে; কবরেও কি আঁকছেন বিমূর্ত চিত্রকলা? এদেশের আধুনিক শিল্পকর্ম আপনাকে মনে রাখবে, আমিনুল ভাই।

সমরজিৎ রায় চৌধুরী :চিত্রশিল্পী
 

No comments

Powered by Blogger.