গোধূলির ছায়াপথে-অন্ধকারের বিড়াল by মুস্তাফা জামান

অন্ধকারে বিড়াল দেখলে ভয় লাগে বৈকি। বাঘের নাম শুনলেই ভয়। লেখার কিছুই নেই, তা নয়। লেখার অনেক। কলম মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। মাহমুদুর রহমান, আসাফ্উদ্দৌলাহ্ ও সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো সাহসী নই, তাঁদের মতো ক্ষুরধার নয় আমার পেনসিল, মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রতিকূলের স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার


মতো বল নেই বলে ছুটে যাই মহৎ জনের কাছে, নবীর কাছে, রুমির কাছে। এখন সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর রবিঠাকুর ও ইরানের কবি হাফিজের কাছে। ওঁদের ওপর বই লিখছি।
বড় ভাইকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, ভয়ও করি। এখনো ডেকে পাঠালে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি, সস্নেহে বসতে বলেন। যদি বসতেই না পাই, তাহলে কথা এগোবে না, বিচার পাব না। তাঁর শাসন মেনে নিয়েছি চিরকাল। জেনেছি, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’। বিচারের আসনে সফল বিচারক তিনি, বাংলাদেশের সফলতম প্রধান বিচারপতিদের একজন। কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন বলে শুনিনি।
অনেক কাল আগের কথা। ইউনূসের মতো অব্যাহতি পেয়েছিলাম বিনা শুনানিতে, দেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির কাছে। এক মাসের মাথায় সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেন বঙ্গবন্ধু সস্নেহে, বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন আমাকে। এখানেই তাঁর জিত। আরেকবার পরিচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও অব্যাহতি পেয়েছিলাম। আজও দুঃখ প্রকাশ পাইনি। এখানেই তাঁর হার।
জীবনে দুটো জিনিস শিখতে হয়, সারা দিন ভুল করার পরও সারা দিন দুঃখ প্রকাশ। নবীকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি আল্লাহর প্রেরিত, আপনার জন্যও দৈনিক এতবার ‘আস্তাগিফরুল্লাহ’ পড়ার প্রয়োজন? উনি বললেন, প্রেরিত হলেও মানুষ হওয়ার কারণে এই ক্ষমা প্রার্থনার অংশীদার।
আজ অনেক বেশি ক্ষমা চেয়েছি আল্লাহর কাছে। যিনি আমার জন্মদাত্রী, সারা বছর ভুলে থাকি তাঁকে। ১১ মার্চ মৃত্যুদিন এলে কবরে গিয়ে অশ্রুবিসর্জন। রোজ পারি না কেন, সে কারণেই আজ এতবার ক্ষমা চাওয়া। সবচেয়ে ভালোবাসি যে মাকে, তাঁর জন্য কিছুই করিনি। কয়েকজন নিরন্ন মানুষের সন্নিকটে যাব, পেটভরে খাওয়ানোর পর চাইব মায়ের জন্য দোয়া। রোজ এমনটি যদি করতে পারতাম, অন্তত একজন নিরন্ন মানুষকে ভাত খাওয়াতে পারতাম, তাহলে ধন্য হতো আমার জীবন।
বন্ধু দিয়েছেন স্লোগান: দেশকে মায়ের মতো ভালোবাসো। মনে হয়েছে, তার আগে মায়ের কাছে যাওয়া উচিত। মায়ের কথা বললাম, পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমার চোখে এখন পানি। সবার মায়ের কথা ভাবলে সবার মায়ের জন্য প্রবাহিত হবে এই অশ্রুরাশি। সবার হয়ে কবি বলছেন: ‘মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখ আসে জল ভরে।’
দেশকে ভালোবেসে কী হবে? ক্ষমতার আসনে বসে ক্ষমতার স্তম্ভ বিস্তার করছি গুণীজনের ওপর। অথচ ক্ষমতা তো তিন দিনের। গুলশান মসজিদে দুজন রাষ্ট্রপতি আমার পাশে প্রতি সপ্তাহে নামাজ পড়েন। তাঁরা আজ আমার মতো সাধারণের কাতারে। অনেক সালাম পেতেন একদিন, আজ এসেছেন সমর্পিতজন হিসেবে। ক্ষমতায় থাকলে নিজেকে ‘প্রকাণ্ড বাঘ’ ভাবি। আমার মেইড, ব্যাঘ্ররূপিণা, বললেন: অন্ধকারে ভাত রান্না করতে পারব না। মোমবাতি নিয়ে আসুন। অত রাতে ছোট দোকানির কাছে দেশলাই ও মোমবাতি কিনতে গেলাম। দোকানি বাঘ বলছেন: একটা মোমবাতি দিতে পারব না, এক ডজন নিতে হবে, দেশলাইও তা-ই।
গৌরবের বাঘের কথা বলি। যেদিন ভারত-বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা হয়, পরিবারসহ কলকাতায়। পশ্চিম বাংলার ইয়াং ছেলেরা মিলে খেলা দেখছে গভীর উৎ সাহের সঙ্গে। চিৎ কার করে জানাচ্ছে তাদের সাপোর্ট ইন্ডিয়ার জন্য, আবার বাংলার টাইগারদের জন্য সহানুভূতির শেষ নেই। একজন বলল: তোমাদের ১১ জন টাইগার বাংলাভাষী, আমাদের টিম বঙ্গভাষী একজনও নেই।
১৯২৬-এ ঢাকা শহরে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় এবং শেষ আগমন। নাতি-নাতনি নিয়ে কবি বেজায় ক্লান্ত। তিন বছরের নাতনি ঢাকায় বাঘ আছে কি না প্রশ্নের উত্তরে কবি বললেন: মেলা বাঘ, রাশি রাশি বাঘ। বাঘ জোর করে ধরে নিয়ে যায়, আর বলে বক্তৃতা দাও, না হয় গল্প বল। [আহমদ কবিরের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’]
শ্রেষ্ঠ মানুষদের অপমানে অংশ নিচ্ছি, এতে কী লাভ হবে? মুহাম্মদ ইউনূসের বয়স মাত্র ৭০। বয়স্ক ও সম্মানী ব্যক্তিদের ধরে ধরে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করলে কেমন হয়? নিয়ম তো নিজেরাই বানাই। এই নতুন নিয়ম হয়তো অনেকের পছন্দ হবে। অসুবিধা একটাই, বয়সের ভারে ন্যুব্জ যাঁরা, সেই পদাধিকারীরাও রেহাই পাবেন না। যাঁরা আমার লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন যে বঙ্গোপসাগর রূপকার্থে ব্যবহূত। ওটির নাম ‘পুলসিরাত’।
ফোনে পেলাম একজনকে। বললেন: অন্ধকারে বিড়াল দেখলে কার না ভয় হয়? শেষ বয়সে দংশিত। ব্যথাটা তাই বেশি। আমি দোয়া পড়ছি, আপনিও পড়ুন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য ও সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.