তাহেরের গোপন বিচার-সুপ্রিম কোর্টে যা বলেছি by লরেন্স লিফশুলজ

আমার নাম লরেন্স লিফশুলজ। পেশায় লেখক। ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে আমি হংকংভিত্তিক পত্রিকা ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলাম, পাশাপাশি বিবিসি ও গার্ডিয়ান-এর প্রদায়কও ছিলাম।


গত জানুয়ারিতে এই আদালত কর্নেল আবু তাহের মামলা সম্পর্কে আমার জ্ঞাত তথ্য-প্রমাণ আদালতের সামনে উপস্থাপন করতে অনুরোধ করেছিলেন।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান এই আদালতে আমার হলফনামা পড়েছিলেন। গত জানুয়ারিতে আমি বাংলাদেশে আসতে পারিনি। কারণ, আমার পরিবারের এক সদস্য সম্প্রতি গুরুতর দুর্ঘটনায় পড়েছিল।
আজ এই আদালতে আপনাদের সামনে উপস্থিত হওয়াটা আমার জীবনে অন্যতম সম্মানজনক বিষয়। আদালত মামলাটির বিষয়ে রায় দেওয়ার শেষ প্রান্তে এসে দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে হাজির হওয়ার অনুরোধ করেন। পরিস্থিতি পাল্টেছে, তাই আমি ঢাকায় এসে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আমরা সবাই এখানে হাজির হয়েছি সভ্য সমাজের অন্যতম অপরিহার্য এক উপাদানের জন্য—তা হলো ‘স্মৃতি’। প্রায় ৩৫ বছর আগে এই নগরে কী ঘটেছিল, তা স্মরণ করতে আমরা এসেছি। সেই সময়ের কথা আমাদের কারও কারও ভালোই স্মরণে আছে। অন্যরা তখন সবেমাত্র শিশু। তবে আমরা এখানে হাজির হয়েছি, কেননা আমাদের অনেকে প্রত্যাখ্যান করেছি বিস্মৃতিকে। এটা স্মৃতির প্রতি আমাদের দায়।
৩৫ বছর ধরে আশা করেছিলাম, একদিন আমি আদালতকক্ষে দাঁড়াব, যেখানে জানব শিগগিরই তাহেরের বিচারসংক্রান্ত মামলার রায় হবে। আর সেই রায়ে ঘোষিত হবে তাহেরের বিচার ও ফাঁসি অবৈধ কি না এবং তা তাঁর সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের মৌলিক লঙ্ঘন ছিল কি না।
আমি কয়েক মাস আগেও জানতাম না, এটা আপনাদের আদালতকক্ষে হবে। বিচারপতি শামসুদ্দিন ও বিচারপতি হোসেন যে এই আদালতের বিচারক, তা-ও আমার অজানা ছিল। আপনারা কি রায় দেবেন, সে বিচার আগেভাগেই আমরা করব না। তবে অনেকের মতো আমিও কয়েক দশক ধরে আজকের এই দিনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। গত সপ্তাহে তাহেরের মেয়ে জয়া জানালেন, ‘আমি সারা জীবন ধরে এই মুহূর্তের প্রতীক্ষা করেছি।’ বাবার মৃত্যুর সময় জয়ার বয়স ছিল পাঁচ বছর। সুতরাং আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, জীবনব্যাপী অপেক্ষার পর আবু তাহেরের জন্য ন্যায়বিচার পেতে অনেকে এখানে এসেছেন।
আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার এক বছর পর তাঁর স্বজন ও সাবেক সহকর্মীরা লন্ডনের কনওয়ে হলে একটি সভার আয়োজন করে। তাঁর মৃত্যুর মাত্র এক বছর পরই মানুষ তাঁর স্মরণে জড়ো হয়েছিল। আপনারা জানেন, ১৯৭৭ সালে ঢাকায় এ ধরনের সভা করা ছিল অসম্ভব। সম্ভাব্য অতিথিদের অনেকে তখন কারাগারে। আমাকে কনওয়ে হলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বলা হলো। সাংবাদিক হিসেবে এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। আমার স্বাধীনতা ও বস্তুনিষ্ঠতা কি প্রশ্নের মুখে পড়বে? ওই সময়ে আমি সভায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে শেষ অবধি আমন্ত্রণ গ্রহণ করার বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। সেখানে বলা কিছু কথা আজও অর্থপূর্ণ বলে মনে করি।
কনওয়ে হলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি সেদিন বলেছিলাম, ‘লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতার মাঝে আমি একটা পার্থক্য টানি। বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কোনো আপস অথবা নিয়ন্ত্রণ চলবে না, নির্ভুলতার চেষ্টা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও কোনো আপস হতে পারে না, তবে আমি মনে করি, কিছু প্রশ্নে ‘নিরপেক্ষতা’ বলতে কিছু নেই। আর এ কারণে আমি তাহের স্মৃতি কমিটির আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। গোপন বিচার ও গোপন ফাঁসির প্রশ্নে আমি নিরপেক্ষ নই। আমি এসবের নিন্দা জানাই। যার দ্বারাই সংগঠিত হোক, সে ফ্রাঙ্কো, স্ট্যালিন বা জেনারেল জিয়াউর রহমান যে-ই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। এক বছর আগে হঠাৎ করেই আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, মামলাটি সবে শুরু হতে যাচ্ছে। মামলাটিতে মৃত্যু, বিশ্বাসঘাতকতা ও বিয়োগান্ত অবিচারের নানা মাত্রা ছিল...আমি জাতিগতভাবে আমেরিকান। আর আমেরিকার ইতিহাসেও অসাধারণ বিচারিক বিচ্যুতির এমন সব আলোচিত ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে’ অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। আমেরিকার তেমন ঘটনার মধ্যে রোসেনবার্গদের, জো হিল এবং সাচ্চো ও ভ্যানজেত্তির ফাঁসির স্মৃতি সবচেয়ে জ্বলজ্বলে। আজ নিকোলা সাচ্চো ও বার্তোলোমেও ভ্যানজেত্তির কথা মনে পড়ছে। এই দরিদ্র অভিবাসীদ্বয় উন্নত জীবনের আশায় ইতালি ছেড়ে আমেরিকায় এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। আজ সাচ্চো ও ভ্যানজেত্তির নাম বললাম, কারণ তাঁদের ফাঁসির ৫০ বছর পর গত মাসে [জুন ১৯৭৭] ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মিচেল ডুকাকিস ঘোষণা করেন, অঙ্গরাজ্যের সরকারি দৃষ্টিতে সাচ্চো ও ভ্যানজেত্তি নিরপরাধ। তাঁদের ভুলভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। গভর্নর আরও ঘোষণা করেন, প্রতিবছর ওই দুই ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকীতে অঙ্গরাজ্যের জনগণ ‘সাচ্চো ও ভ্যানজেত্তি স্মৃতি দিবস’ পালন করবে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির কাষ্ঠে যা ঘটেছিল, তা ঠিক করতে বাংলাদেশের জনগণের এত দীর্ঘ সময় লাগবে কি না আমার সন্দেহ।’
এত সময় লাগবে, এটা কে জানত? সাচ্চো ও ভ্যানজেত্তির ক্ষেত্রে ৫০ বছর পেরোলেও এখানে এখনো পার হয়নি। যা হোক, আবু তাহেরের মৃত্যুর প্রায় ৩৫ বছর পার হয়েছে। বিষয়টি ন্যায়সম্মতভাবে মোকাবিলার সময় এসেছে। তাহের ও তাঁর সহকর্মীরা ‘বিচারের’ মুখোমুখি হয়েছিলেন—এ কথাও কি বলা যায়? ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ‘বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল-১’ স্থাপন করা হয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কথিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দারের মতো বহু লোককে কারাগারের ফটকের ভেতর ঢুকতে লোকদের দেখেছিলাম।
তারা তাদেরকে লুকাতে আর মুখ ঢেকে রাখতে চেষ্টা করতে থাকলেও আমি তাদের ছবি তুলেছিলাম। তাৎক্ষণিক আমার ক্যামেরা ও ফিল্ম কেড়ে নেওয়া হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, কখনো আমাকে জানানো হয়নি।
তবে এই ‘ভুতুড়ে’ ট্রাইব্যুনালের কোনো নথিপত্র আজ পাওয়া যায় না। তারা যা করেছে, তা লুকাতে চেষ্টা করছিল। মামলার নথিপত্র কোথায় গেল, তা শুধু জর্জ ওরওয়েলই হয়তো আমাদের ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যারা এই অপরাধ করেছে, তারা এখানে হাজির হওয়া মানুষদের মতো নয়। তারা কেউ চায়নি, তাদের কৃতকর্ম কেউ ভবিষ্যতে মনে করবে কিংবা মনে করবে তারা কারা ছিল। নিজেদের অপরাধ গোপন রাখতে চেয়েছিল তারা। এই আদালত দেখেছে কোনো নথি নেই। নেই কোনো ট্রান্সক্রিপ্ট। মামলার কোনো ‘দাপ্তরিক নথিপত্র’ নেই। শুরু থেকেই তারা সবকিছু গোপন করতে চেয়েছিল।
সেই সব ‘ক্ষমতাবান মানুষেরা’ ভাবেনি এই ইতিহাস হারিয়ে যাবে না, এটি প্রকাশিত হবে। আমরা এখানে স্মরণ করতে এসেছি। আর বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এখন স্মরণের এই প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
তখন কী ঘটেছিল সেই কঠিন সত্য উদ্ঘাটনের দুঃসাধ্য কাজ করছেন এই আদালত। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের আদালতে হাজির হওয়ার অনুরোধ এবং অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আমি আমার হলফনামায় ইঙ্গিত করেছিলাম, যা ঘটেছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিচার’ বলা যায়, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। এটা এমনকি ‘লোকদেখানো বিচারও’ নয়। কারণ সামরিক সরকার এটাকে লোকচক্ষুর সামনে আনতে চায়নি। আইনসম্মতভাবে তৈরি আদালত ও মুক্ত গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে স্বাধীন বিচার হলে তার যে প্রতিক্রিয়া হবে সেই সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার সরকার শঙ্কিত ছিল।
গত ৩১ জানুয়ারির হলফনামায় আমি জেনারেল মোহাম্মদ মঞ্জুরের সঙ্গে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শুরুর এক মাস আগে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের কার্যালয়ে কীভাবে সাক্ষাৎ করেছি, তার কিছু বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছি। ওই সময় মঞ্জুর ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ। মঞ্জুরের সঙ্গে আমার কয়েক বছরের জানাশোনা। মঞ্জুর কীভাবে তাহেরের কথিত বিচারের বিরোধিতা করেছেন, তা আমি বর্ণনা করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন, কথিত বিচার-প্রক্রিয়া বন্ধ করতে সবকিছু করছেন।
স্পষ্টত মঞ্জুর সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছিলেন। কিছুদিন পরই তারা মঞ্জুরের পেছনে লাগে। তাহেরের ফাঁসির পর তিনি আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য দূত পাঠান। ওই সময়ে আমি ইংল্যান্ডে থাকতাম। তিনি আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন যে, কর্নেল ইউসুফ হায়দারের কথিত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরুর আগেই জেনারেল জিয়া ব্যক্তিগতভাবে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
জানুয়ারির শেষে মওদুদ আহমদ (তাঁকে আমি তরুণ মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে জানতাম) আমার লেখা উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে বেশ কিছু বক্তব্য তুলে ধরেন, যার প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে ভুলভাবে উপস্থাপিত। তরুণ মওদুদকে যে আদর্শের ধারক বলে জানতাম, তা থেকে তিনি অনেক দূরে সরে গেছেন। ক্ষমতার সড়কে এটা বিরল নয়। তবে তাঁর একটি দাবি এই আদালতের বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
মওদুদ আহমদ দাবি করেন, জিয়াউর রহমান ৪৬ জন ‘প্রত্যাবাসিত’ কর্মকর্তাকে জমায়েত করেছিলেন তাহেরকে কী সাজা দেওয়া উচিত, তা আলোচনার জন্য। এটা সবার জানা যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো সামরিক কর্মকর্তাই বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু জেনারেল জিয়ার প্রত্যাবাসিত কর্মকর্তাদের এই জমায়েত তাহেরের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছে। তাঁরা তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিলেন।
মওদুদ দাবি করেছেন, তাঁর দাবির সূত্র জেনারেল জিয়া নিজেই। তাহেরের বিচারের রায় কী হবে, সে ব্যাপারে জেনারেল জিয়া ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এই জায়গাতে মওদুদের বর্ণনার সঙ্গে জেনারেল মঞ্জুরের বর্ণনা মিলে যায়। এরপর তিনি প্রায় ৫০ জন সামরিক কর্মকর্তাকে তাঁর সিদ্ধান্তের বৈধতা দিতে বলেন।
এ ব্যাপারে আমরা কী বলতে পারি? এটাকে ‘আইনসম্মত কার্যপ্রণালি’ বলার জন্য কত দূর পর্যন্ত কল্পনাশক্তির প্রসারণ ঘটাতে হয়? কোন কর্তৃত্ব অথবা আইনের বলে অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু সেনাসদস্য বিচারক ও জুরির ভূমিকা নিজেদের হাতে তুলে নিলেন? সামরিক স্বৈরতন্ত্র নিজেরাই নিজেদের নিয়ম রচনা করে আর এ ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই ঘটেছে।
১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকের পেছনে যা ঘটেছে, তাকে সবচেয়ে যথাযথভাবে বর্ণনার পথ আমার মনে হয় স্বীকার করে নেওয়া যে, যা ঘটেছিল, তা আসলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের আয়োজনে একধরনের ‘বিনা বিচারে হত্যা’। কোনো বিচার হয়নি। বিচারের ছদ্মবেশ তৈরি করা হয়েছিল—বিচারের পোশাকি চেহারা দেওয়া হয়েছিল। তথাপি দ্রুত ছদ্মবেশটাও খসে পড়ল। যদি এটা বিচারই হয়, তবে তা কেন কোনো আদালতে হলো না? কারাগারে অনুষ্ঠিত হলো। কী ধরনের বিচার হয় কারাগারে? উত্তর হলো, সেই ধরনের বিচার, যা বিচারই নয়।
কর্নেল তাহেরের মেয়ে জয়া তাহেরের কাছে তাঁর বাবার প্রতি যা ঘটেছে, তার চরিত্র ‘হত্যাকাণ্ডের’। সেই হত্যাকাণ্ডের কার্যসাধন পদ্ধতি ছিল বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল নম্বর ১। হয়তো জয়া তাহেরের এই মত সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি।
তাহেরের মামলাটিকে সৈয়দ বদরুল আহ্সান ‘হত্যা ছাড়া কিছু নয়’ বলে অভিহিত করেছেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘কর্নেল আবু তাহের সম্পর্কে এবং তাঁকে মেরে ফেলার (এটা হত্যা ছাড়া কিছুই নয়) ভয়ংকর কায়দা সম্পর্কে [লিফশুলজ] যখন কথা বলেন, তখন তিনি আমাদের মনের ভেতরকার সেই বেদনা ফিরিয়ে আনেন, সে বেদনা হয় আমরা খুব সযতনে এত বছর ধরে ঠেলে সরিয়ে রেখেছি, নয়তো এই দেশে অসত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে আমাদের তা অনুভব করতে দেওয়া হয়নি।’ (সৈয়দ বদরুল আহ্সান, ‘কর্নেল তাহের, লিফশুলজ অ্যান্ড আওয়ার কালেকটিভ গিল্ট’, দ্য ডেইলি স্টার, ২৬ জুলাই ২০০৬)।
বদরুল আহ্সানের এই মত অংশত সঠিক, তবে পুরোপুরি নয়। তাহেরের মামলাকে যখন তিনি ‘হত্যা ছাড়া কিছু নয়’ বলেন, তখন তাঁর বক্তব্যে ঘটনাটি যে পূর্বপরিকল্পিত কিংবা তাহের অনুমান করতে পেরেছিলেন—এই দিকগুলো বাদ পড়ে যায়। মওদুদ আহমদ আর যা-ই করুন না কেন, তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে জেনারেল জিয়া পূর্বপরিকল্পিত কায়দায় এই খুনসূচক কাজটি করেছিলেন। আর আইনের অধীনে থেকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের তাৎপর্য বিরাট।
এর মানে হলো, আপনি কী করেছেন, তা বুঝেশুনে করেছেন আর সেই অনুযায়ীই আপনার অপরাধকর্মের পরিকল্পনা করেছেন। অপরাধ-সম্পর্কিত আইনে পূর্বপরিকল্পিত খুন প্রথম স্তরের খুন হিসেবে গণ্য। (মওদুদ আহমদ কেন এই ব্যক্তির সহযোগী ছিলেন এবং তাঁর সরকারের মন্ত্রী ছিলেন সেই প্রশ্ন অন্যত্র আলোচনা করা যাবে)।
২০০৬ সালের প্রবন্ধে বদরুল আহ্সান বাংলাদেশে ‘অসত্যের দীর্ঘ যাত্রা’র কথা বলেছেন। পাঁচ বছর আগেকার পরিস্থিতির আলোকে তাঁর এ বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে সঠিক। তবে, এখন নতুন দশার সূচনা হয়েছে বলে মনে হয়। সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীকে সংবিধান-পরিপন্থী ঘোষণার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট পরপর দুটি সামরিক সরকার কর্তৃক তাদের অতীত কর্মকাণ্ড সব ধরনের জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে অকার্যকর করে দিয়েছেন। আদালত দৃঢ়ভাবে বেশ কিছু বিষয় তুলেছেন, যা এক নতুন ও চ্যালেঞ্জিং সময়ের একদম কেন্দ্রীয় বিষয়।
এই সমাজের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এই আদালত; পরিবর্তনের সম্ভাব্য এক উপাদানও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়ারেন কোর্ট বর্ণবৈষম্যের দ্বার ভেঙে ফেলেছিলেন—হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন সমাজ পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে বাংলাদেশ। আসলে অলঙ্ঘনীয় সংবিধান আর ‘আইনের শাসন’ এর কোনো অর্থ যদি থেকে থাকে, তাহলে বেসামরিক আদালতকেই হয়ে উঠতে হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর, সত্যিকারের কর্তৃত্বধারী।
স্বল্পসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা মিলে আর কোনো দিন যেন নিজেদের ‘বিচারক ও জুরি’ বানিয়ে নিতে না পারেন আর বেসামরিক আইনি কর্তৃপক্ষকে ডিঙিয়ে যেতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতেই হবে। এটা কেন্দ্রীয় বিষয়। প্রশ্নটা কেবল ‘শাসনের শাসনই’ চূড়ান্ত হবে কি না, তা-ই নয়, বরং বিচার বিভাগ তার সর্বোচ্চ অবস্থানের সুরক্ষা দেওয়ার শক্তি অর্জন করতে পারবে কি না সেটাও। পরিষ্কারভাবেই সে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট।
এই দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আবারও বিপন্ন হতে দিতে না চাইলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ‘মানসিকতা’ ভাঙতেই হবে। গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মজবুত করার ক্ষেত্রে আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী উল্টে ফেলে এক তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—সশস্ত্র বাহিনীর কাছে দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে তারা যদি আবার কখনো তাদের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং সশস্ত্র স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে, তাহলে সংবিধান ও ‘আইনের শাসন’ লঙ্ঘনের জন্য তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ।
তাহেরের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সামনে চ্যালেঞ্জটি হলো, ‘বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল নম্বর-১’ কর্তৃক অনুসৃত কর্মপদ্ধতি কি কোনোভাবে আইনসম্মত কিংবা সাংবিধানিক কি না, তা নির্ণয় করা। যদি তা না হয়, তাহলে এর চরিত্র যথাযথভাবে নির্ধারণ করা উচিত।
তাহেরের পরিবারের জন্য এটা এক অপরিহার্য ব্যাপার। সংবিধানের আওতায় আইনি ভিত্তি নেই এমন এক ট্রাইব্যুনাল, যার দলিলপত্রাদি ‘নিরুদ্দেশ’ তার ‘রায়’কে কি টিকে থাকতে দেওয়া হবে, নাকি ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গোপন আইনি ব্যবস্থা উল্টে যাবে—অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষিত হবে? তাহেরের স্ত্রী ও তিন সন্তানের কাছে এটাই গুরুত্বের। বাকি সব বাড়তি পাওনা।
১০ দিন আগে তাহেরের মেয়ে জয়া আমাকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাতে লিখেছেন, ‘অধীর হয়ে বসে আছি রায়ের প্রতীক্ষায়।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘রায়ের ফলে বাবাকে ফিরে পাব না’ কিন্তু তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো তাতে থামবে—এত অল্প বয়সে তাঁকে ও তাঁর দুই ভাইকে হারাতে হয়েছে তাঁদের বাবা। অভিযোগ থেকে বাবার মুক্তি এবং যেমন মহান মানুষ ছিলেন তিনি, তেমন মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হলে তাঁদের আত্মায় কিছুটা শান্তি আসবে। বিচারপতি শামসুদ্দিন ও বিচারপতি হোসেন, আপনারা তা সম্পাদন করলে একটি অত্যন্ত মহৎ ও উত্তম কাজ সম্পাদন করবেন।
আজ থেকে ৩৫ বছর আগে এ মাসেই আমি ‘আবু তাহেরস লাস্ট টেস্টামেন্ট’ লেখাটা শেষ করি। তখন ১৯৭৭-এর বসন্তকাল। আমি তরুণ। বয়স মাত্র ২৬। তাহেরের বিচার এবং বাংলাদেশ থেকে আমি বিতাড়িত হওয়ার পর এক বছরও পেরোয়নি। আমি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে বাস করছি। শেষ পৃষ্ঠা টাইপ করার সময়ের কথা মনে পড়ছে। লেখাটি আরেকবার পড়লাম। তারপর এক কপি খামে ভরলাম।
আমি তখন ক্লেয়ার স্ট্রিটের ছোট এক বাড়িতে থাকতাম। মনে পড়ছে, আমি হাঁটতে হাঁটতে কাছের ছোট এক ডাকঘরে গেলাম। ডাকঘরকর্মী আমার পরিচিত। প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্ট্যাম্প কিনলাম আর দুটি এয়ার মেইল স্টিকার। খামের গায়ে প্রেরকের নাম লিখলাম কৃষ্ণা রাজ। তিনি বোম্বের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির (ইপিডব্লিউ) সম্পাদক। তিনি লেখাটি ছাপবেন কি না, সংশয় ছিল। ডাকবাক্সে গলিয়ে দিলাম খামটা।
১৯৭৭ সালের আগস্টে ইপিডব্লিউ-এর বিশেষ সংখ্যায় লেখাটি ছাপা হলো। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশবিষয়ক এক বইয়ের অংশ হয়ে গেল। বাংলাদেশে বইটি এক দশকের অধিক কাল নিষিদ্ধ থাকল। আমার প্রথম অভিপ্রায় ছিল, বাংলাদেশে পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশ করা। তবে স্পষ্টতই তা সম্ভব ছিল না।
অবশ্য তাহেরস লাস্ট টেস্টামেন্ট লিখতে আমাকে বাধ্য করেছে গুরুত্বপূর্ণ দুই ঘটনা। যা যা ঘটেছে, সে বিবরণ কীভাবে লেখা যায়—এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করছিলাম। তখন ঘটনা দুটি ঘটল। বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাহেরের গোপন সাক্ষ্যের কপি আমার হাতে এল। লন্ডন থেকে কোনো এক ব্যক্তি ফোন করে জানিয়েছিলেন, ঢাকা থেকে আনা একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল তাঁরা আমাকে চিঠিতে পাঠাবেন। দলিলটি পাওয়ার পর পড়লাম। খুব আলোড়ন বোধ করলাম। অসীম সাহসী ও নিষ্ঠাবান এক মানুষের এক অসাধারণ বিবৃতি।
তারপর যা ঘটল, তাতেই আমার সংশয় কেটে গেল। তাহেরের স্ত্রী লুৎফা অক্সফোর্ডে অবস্থানরত তাঁর ভাইকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেটির অনুবাদ পেলাম। এটা আমার পড়া সবচেয়ে সুন্দর চিঠিগুলোর অন্যতম।
লুৎফার সে চিঠির অংশবিশেষ পাঠ করার মাধ্যমে আদালতে আমার সাক্ষ্য শেষ করতে চাই। আজ লুৎফা এখানে উপস্থিত আছেন।
‘প্রিয় বড় ভাইজান,
আপনাকে আজ কি লিখব, ভাবতে পারছি না। তাহের আর আমার সঙ্গে নেই—এটা আমি হূদয়ঙ্গম করতে পারি না। ভাবতে পারি না, আমার জীবনসঙ্গী চলে যাওয়ার পর আমি কিভাবে বাঁচব। আমাদের সন্তানেরা মনে হয় বিরাট সমস্যায়। এত ছোট শিশুরা কিছুই বোঝে না। নিতু বলে, ‘‘বাবা, তুমি মরে গেলে কেন? তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে তুমি বেঁচে থাকতে।”
সন্তানেরা বোঝে না তারা কি হারিয়েছে। প্রতিদিন তারা কবরে যায় ফুল নিয়ে। কবরে ফুল দিয়ে তারা প্রার্থনা করে, “আমি যেন বাবার মতো হই।” যিশু বলে, বাবা চাঁদের দেশে ঘুমায়...
আমি খুব ভাগ্যবতী...সে যখন বেঁচে ছিল, তখন আমাকে বাঙালি মেয়েদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে সে আমাকে দিয়েছে বিশ্বের সম্মান। এত অল্প সময়ে আমার সব চাওয়া পূর্ণ করল সে। তাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধারা যখন আমাকে সমবেদনা জানায়, তখন আমি ভাবি: তাদের মাঝে বেঁচে আছে আমার তাহের, আর বেঁচে থাকবে তাদের মাঝেই। তারা আমার আপন মানুষের মতোই। আমি গর্বিত। সে মৃত্যুকে জয় করেছে। মৃত্যু তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি...
যদিও চারপাশে শুধুই আঁধার আর আমি খুঁজে পাচ্ছি না নোঙর, হারিয়ে গেছি আমি, তবু জানি, এই দুর্দিনই শেষ কথা নয়। এরও আছে অবসান। যেদিন দেখব, তাহেরের আদর্শ হয়েছে সবার আদর্শ, সেদিন শান্তি পাব। আমার দুঃখ, সেই দিন যখন আসবে, তখন তাহের সেখানে থাকবে না।
আপনার আদরের,
লুৎফা’
১৪ মার্চ ২০১১
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব ও এ এইচ এম ইয়াসিন
লরেন্স লিফশুলজ: মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.