চুক্তির জবাবদিহিতা ও প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকার-লেখকবৃন্দ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

দেশ স্বাধীন মানে নাগরিকেরাও স্বাধীন। সেই রকম স্বাধীন যা আইনের অধীন। সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করা, সরকারি চিন্তার সমালোচনা করা স্বাধীন দেশের নাগরিকের আইনি অধিকার। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রসঙ্গে মনে হচ্ছে, আইনের নিরিখে নয়, সরকার তাদের পছন্দের নিরিখেই ঠিক করছে কার কতটা অধিকার।


দীর্ঘ প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় গত ৩ জুলাই জাতীয় স্বার্থে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করেছিল। তাদের দাবি ছিল বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি প্রকাশ করা হোক, বাতিল করা হোক জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই চুক্তির ধারাগুলো। কিন্তু সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী জাতীয় কমিটিকে 'অবৈধ' বলে ঘোষণা করতে থাকেন। এর নেতৃবৃন্দের অভিলাষী জীবনযাপনকে কটাক্ষ করেন, কমিটিকে বলেন 'টোকাইদের কমিটি'। এমনকি হরতালের দিনে যখন অজস্র নেতাকর্মী গ্রেফতার ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করেন, 'কমিটি বিদেশি প্রভুর স্বার্থ দেখছে।' এ ধরনের বেপরোয়া মন্তব্য এবং বেপরোয়া পুলিশি দমন-পীড়ন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার বলে আমরা মনে করি না। দুটিই অগণতান্ত্রিক আচরণ।
সংসদে যে কোনো চুক্তি প্রকাশ ও আলোচনার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও আমরা দেখলাম এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিন্দিত চুক্তিটি প্রবল প্রতিরোধের মুখেও সরকার নীরবে সম্পাদন করে ফেলল। চুক্তিটি যদি জাতীয় স্বার্থের পক্ষেই হবে, তাহলে এটা প্রকাশে ভীত হচ্ছেন কেন তারা? সংসদে এখন তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানে নিজের দলের লোকদের সামনেও যা প্রকাশ করা যায় না, তা তারা জনগণের সামনে প্রকাশ করতে ভয় পাবেন এটা স্বাভাবিক। এর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক, সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিকদের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ হওয়াও খুবই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, যারা তেলের জন্য ইরাক-আফগানিস্তান দখল করে রেখেছে, যারা লিবিয়ার মতো দেশগুলোর খনিজ সম্পদ দখলের পাঁয়তারা করছে, সেই আমেরিকার একটি তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানির পক্ষে কাজ করছে যারা, বিদেশিদের হয়ে কাজ করার অভিযোগ তো তাদের বেলাতেই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। দেশের গ্যাসসম্পদ দেশের কাজে লাগানোর কথা বললে কীভাবে বিদেশিরা উপকৃত হবে, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। নাকি বিদেশি কোম্পানি-প্রীতিকেই তারা 'দেশপ্রেম' মনে করেন? আর স্বদেশপ্রেমকে মনে করেন অপরাধ?
তাহলে কি এই 'অপরাধেই' গত ৩ জুলাই হরতাল এবং সেই হরতাল আহ্বানকারী জাতীয় কমিটির কার্যক্রমকে নানা খোঁড়া যুক্তিতে খারিজ করে দিতে চায় এই সরকার? সে কারণেই কি একদিনেই শতাধিক নেতাকর্মীকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় আটক রাখলেন? পুলিশ লেলিয়ে দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পল্টনে, মোহাম্মদপুরে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির ভেতরে ঢুকে পড়ে শিক্ষার্থীদের, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের অফিসে ঢুকে নারীদের বেধড়ক পেটাল পুলিশ? যে সরকার শুধু ভোটের অধিকারের কথা বলে প্রতিবাদের অধিকার হরণ করতে চায়, সে সরকার কি তাহলে গণতান্ত্রিক? ৩ জুনের শান্তিপূর্ণ হরতালের সময় পুলিশি নির্যাতন সরকারের এই স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থানকেই দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করে।
সবাই জানেন, দেশের সম্পদ-সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেতনা থেকে ১৯৯৭ সালে তেল গ্যাস কয়লা ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। এই দীর্ঘ চৌদ্দ বছরে তারা নিরলসভাবে দেশের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে দেশের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগানোর জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে তাদের প্রথম বড় সাফল্যটি আসে ২০০১ সালে। বিবিয়ানা লংমার্চের মাধ্যমে তারা সিলেটের বিবিয়ানা থেকে সে সময়ের বিএনপি সরকারের গ্যাস রফতানির প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এতে করে বেঁচে যায় হাজার লাখ কোটি টাকার অমূল্য গ্যাসসম্পদ। তাদের নেতৃত্বে ফুলবাড়ী অভ্যুত্থানের (২০০৬) মাধ্যমে দুর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত কুখ্যাত এশিয়া এনার্জি কোম্পানিকে ফুলবাড়ীর কয়লা খনি থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়। আন্দোলনের পথপরিক্রমায় ফুলবাড়ীতে বিডিআরের গুলিতে নিহত হন তরিকুল, সালেকিন আর আমিন। আর সে সময় আজকের এই আওয়ামী লীগ (যারা জাতীয় কমিটির হরতাল করার রাজনৈতিক অধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে) ২০০৬-এর ফুলবাড়ী হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় কমিটির ডাকা হরতাল সমর্থন করেছিল। এই আন্দোলন দুটি সফল না হলে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাই শুধু নয়, জনগণের নিরাপত্তাও ভয়ানকভাবে হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ত। সুতরাং অবস্থা দেখে এখন যে কারও মনে হতে পারে, বাংলাদেশের সরকারই তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করছে না, স্বার্থ দেখছে বিদেশি কোম্পানির।
বিএনপি সরকারের আমলেও নানাভাবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রচারণা দিয়ে জাতীয় কমিটির প্রতিবাদকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। জাতীয় কমিটির নেতাদের 'সস্তা' শার্ট পরা 'গরিব' বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা যে হাস্যকর, তা আজ সবাই বোঝে। আর তাই জাতীয় কমিটির দেশপ্রেমের সামনে ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকেও দেশপ্রেমের দাবি করতে হয়। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী এবং বামপন্থি সংগঠনগুলোর এই দৃপ্ত প্রতিবাদী চেতনাকে মোকাবেলার জন্য তৈরি রাখা হয় হাজার হাজার পুলিশ, জলকামান, বন্দুক ও টিয়ারশেল। পথে নামার আগেই তারা গ্রেফতার করে প্রতিবাদকারীদের। এমনকি গণমাধ্যমকেও প্রভাবিত করা হয়, যাতে হরতালের দিনে পুলিশের ফ্যাসিবাদী আচরণের সত্যিকার চিত্র দেশের মানুষ জানতে না পারে। সত্যের সূর্যকে কি মিথ্যার চাদর দিয়ে আড়াল করা যায়? তা যায় না বলেই সরকার নিজের চোখকে অন্ধকারে রাখছে, খুঁজছে ষড়যন্ত্র। কিন্তু অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় বন্ধ হয়ে যায় না।
কোনো দলীয় স্বার্থ নয়, দেশের সম্পদ বাঁচাতে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে তরুণরা আজ প্রতিবাদী হচ্ছেন, গ্রেফতার বরণ করছেন, হচ্ছেন নির্যাতিত তারাই আমাদের অনুপ্রেরণা, তারাই এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন বায়ান্ন থেকে একাত্তরের দেশপ্রেমিকদের কথা, মনে করিয়ে দিচ্ছেন আশির দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী নূর হোসেন ও ড. মিলনদের কথা। গ্রেফতার-নির্যাতন দিয়ে প্রতিবাদী স্বরকে রোখা যায় না, ইতিহাসে তা বারবার প্রমাণিত। আজকের এই পুলিশি নির্যাতন, গণগ্রেফতার নতুন করে চেনাল প্রতিবাদী চেতনার শক্তিকে, চেনাল এই শক্তিতে ভীত সরকারকে। কিন্তু সরকার যদি দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে, তাহলে তো এই তরুণদেরই তাদের স্বাগত জানানোর কথা। থানা-হাজতে আটকে রাখার বদলে তাদের দেওয়ার কথা ফুলের মালা। সরকার সত্যবাদী হলে সত্য প্রকাশে তো আনন্দিতই হওয়ার কথা। কিন্তু তার অন্যথা হচ্ছে দেখেই আমাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। সম্পদ পাচারের জন্য সরকার ও বিরোধী দলের যোগসাজশ এবং ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ির নাটক, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশি নির্যাতনের এই বিষাক্ত চক্রের বাইরে তাকাতে হবে দেশবাসীকে। এখন তাই সময় এসেছে নির্বাচিত সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্র প্রমাণের। সরকারে প্রতি আমাদের দাবি, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আপনাদের রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি, দেশের সম্পদ কী চুক্তিতে, কী শর্তে বিদেশিদের হাতে তুলে দিচ্ছেন তার সুস্পষ্ট জবাবদিহি এবং দেশের স্বার্থবিরোধী তৎপরতা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
 

No comments

Powered by Blogger.