মানুষের মুখ-‘বুক দিয়া আগলাই রাখি এই পতাকা’ by শারমিন নাহার

একটা নির্জন দ্বীপে, যার সূর্য ওঠে আর ডোবে। অর্থাৎ তাঁর বসবাস একটা দ্বীপে, জীবন তাঁর চলে, তবে তা কিছুটা মন্থর গতিতে। হোসেন আলীর কথা বলছি। অনেকেই দ্বীপ আর নামের মধ্যে মিল পেয়ে ভেবে বসতে পারেন, তিনি হয়তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের হোসেন মিয়া, যিনি ময়না দ্বীপের অধীশ্বর।


আমাদের এই হোসেন আলী উপন্যাসের কোনো চরিত্র নয়। তিনি একজন সাহসী মানুষ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে কিছুটা দক্ষিণে অবস্থিত তিন বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট ছেঁড়াদ্বীপে তাঁর বসবাস। ১৪ বছর ধরে ছেঁড়াদ্বীপের সঙ্গে তাঁর সখ্য। উত্তাল সাগর পেরিয়ে নীল পানিতে ঘেরা ছেঁড়াদ্বীপে আমরা যখন পৌঁছাই, তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। হোসেন আলী অনেকটা সব্যসাচী। এক হাতে ভেজে চলেছেন সাগরের মাছ, অন্য হাতে বানিয়ে চলেছেন চা-কফি। কাউকে গরম মাছ ভাজা আর কাউকে চা-কফি দিয়ে সন্তুষ্ট করে যাচ্ছেন তিনি। সবকিছু পর্যটকদের জন্য। এত ব্যস্ততার মধ্যে অনুমতি নিয়েই কথা বলতে শুরু করি তাঁর সঙ্গে।
জানতে চাইলাম, কেন সব ছেড়েছুড়ে প্রবালবেষ্টিত এই বালুর দ্বীপে ঠাঁই খুঁজলেন?
উত্তর দিতে বিলম্ব হলো না হোসেন আলীর, ‘মানুষের ভালোবাসার টানিই ইহানে পড়ি আছি। যিয়ান আসি, তিহান ইহানে মিডা পানি আছিল না। ইহানে আছিল জঙ্গল, তহন খুব ডর করত। দিনেমানে ভাটা লাগি আতাম আর ভাটা লাগি চলি যাতাম। এমবে করি তিন বছর কাটি গেল। এরপরে বসত করলাম ছিঁড়াদ্বীপি। কি যেন এক টান—ছাড়তি পারি নাই। থাকনের লাইগা আমি আর বউ মিলা জঙ্গল কাটি সাফ করছি।’ কথাগুলো বলার সময় হোসেন আলীর চোখেমুখে কিছু জয় করার আনন্দ যেন ঝিকমিক করছিল।
ছেঁড়াদ্বীপ তাঁর স্বপ্নের ভূমি। জন্মসূত্রে হোসেন আলী সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা হলেও এখন তাঁর নিজ আবাস ছেঁড়াদ্বীপে। ছয় সন্তানের জনক তিনি। পর্যটকদের ঠিকমতো সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও করেছেন। বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পকে আরও উন্নত করা যেতে পারে—এই ভাবনা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় সব সময়। আর তাই ছেঁড়াদ্বীপ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বটা যেন নিজের কাঁধে চাপিয়েছেন তিনি। নিজ উদ্যোগে তৈরি করেছেন ময়লা ফেলার জায়গা। হোসেন আলী বলেন, ‘নিজের মতো করিই ছিঁড়াদ্বীপটারে পরিষ্কার করি রাখি। অনেকেই টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন থেকে ব্যবসা করতি আসি বিচরে নোংরা করছে। গাছ কাটি ফেলছে, তয় একটা গাছ লাগায় না।’
নিজ উদ্যোগে তিনি লাগিয়েছেন আড়াই শ ঝাউগাছ। দ্বীপের সৌন্দর্যের দিকটা তো তাঁকেই দেখতে হবে। হোসেন আলীর সংগ্রহে আছে বিভিন্ন আকার আর রঙের বেশ কয়েক ধরনের প্রবাল। অনেকেই এসে বলে, এটা কোন দেশের অংশ? তাই দেশের চিহ্ন হিসেবে রেখেছেন জাতীয় পতাকা। হোসেন আলী বলেন, ‘বুক দিয়া আগলাই রাখি এই পতাকা।’
এরই মধ্যে দেখা যায় কোনো কোনো পর্যটক পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। ছোট পলিথিনের বেড়ার ঘর হোসেন আলীর, তাতে তাঁর কোনো কষ্ট হয় না। তাঁর কষ্ট হয় তখন, যখন নির্বিচারে ছেঁড়াদ্বীপ থেকে কেউ গাছ কাটে। এরই মধ্যে এক বিদেশি পর্যটকের সঙ্গে কথা সেরে নেন হোসেন আলী। কেবল আঞ্চলিক ভাষাই নয়, এরই মধ্যে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিও আয়ত্ত করে ফেলেছেন তিনি। ছেঁড়াদ্বীপের এই ছোট ব্যবসা তার বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। তবে ব্যবসার মালামাল আনতে তাঁকে এই উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হয় টেকনাফ। হোসেন আলীর মৃদু হাসি উত্তরটা বলে দেয়—জীবন যেখানে সংগ্রামের, সেখানে সাগর পাড়ি কোনো ঘটনা নয়। বারবার তিনি প্রকৃতিকে পরিচ্ছন্ন রাখার কথা বলেন। ‘নিজের দেশ আর বিচরে ইজ্জত করলেই পর্যটকরা ইজ্জত দেয় আমাগে।’
ছেঁড়াদ্বীপের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছেন হোসেন আলী। এখন ছেঁড়াদ্বীপ আর হোসেন আলী আলাদা কোনো নাম নয়। এটা পর্যটকদের এখানে আসার মৌসুম। শীত-গ্রীষ্মে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এখানে বেশি আসে। এ কারণেই হোসেন আলীর ব্যস্ততা খানিকটা বেশি। তাই উঠে পড়তে হলো। গরম ভাজা মাছের স্বাদ নিয়ে পা বাড়ালাম ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

No comments

Powered by Blogger.