সময়ের প্রেক্ষিত-ভূমিকম্পের শিক্ষা by মনজুরুল হক

জাপানের শুক্রবারের ভূমিকম্প ছিল সর্বকালের সবচেয়ে প্রচণ্ড ভূমিকম্পের একটি। ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপকের রিখটার হিসাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা, হোনশু দ্বীপের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মিয়াগিতে এর প্রচণ্ডতা রেকর্ড করা হয় ৮ দশমিক ৮, যা হচ্ছে ১৯২৩ সালের প্রলয়ংকরী কান্ত ভূমিকম্পের প্রচণ্ডতার চেয়ে আরও এক মাত্রা ওপরে।


গত শতকের সেই ভূমিকম্পে টোকিও-ইয়োকোহামা এলাকায় নিহতের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে ভূমিকম্পের পর ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়েছিল হাজার হাজার ঘরবাড়ি। সেদিক থেকে এবারের ভূমিকম্পে হতাহতের সংখ্যা বলা যায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এর একটি কারণ অবশ্যই হচ্ছে, ভূমিকম্পের বিধ্বংসী চরিত্র সম্পর্কে সরকার ও বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি নাগরিক জীবনে অগ্রসর প্রযুক্তি ব্যবহার ও সেই সঙ্গে টেকসই ভবন নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় জাপানের সরে আসা। কান্ত মহাভূমিকম্প সেদিক থেকে দেশের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বড় এক শিক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছিল।
তবে কথা হচ্ছে, মানুষের প্রাণহানির বেলায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের বেলায় কিন্তু ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থা এখনো ততটা কার্যকর হয়ে দেখা দেয়নি। উল্টোভাবে বরং প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অন্যদিক থেকে আবার মানবজীবনের সামনে দেখা দেওয়া হুমকিকে কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবারের ভূমিকম্পে দেশের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অন্তত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেলায় পরমাণু চুল্লির শীতলীকরণ প্রক্রিয়া অকেজো হয়ে পড়া থেকে দেখা দেওয়া ঝুঁকি অগ্রসর প্রযুক্তির এই বিপজ্জনক দিকটিকেই আরও ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলে এটাকে নতুন করে আবারও নাগরিক বিতর্কের একটি বিষয়ে পরিণত করেছে।
ফুকুশিমা জেলায় অবস্থিত দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ফুকুশিমা-১ ও ফুকুশিমা-২—উভয় কেন্দ্রেই শীতলীকরণে ব্যবহারের পানি ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি উত্তপ্ত হয়ে গেলে কারখানা দুটি বন্ধ করে দিতে হয়। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে জাপানের আণবিক শক্তি এজেন্সি আরও কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎ পাদন স্থগিত রাখায় জাপানকে এখন হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ ঘাটতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎ পাদন প্রক্রিয়াকে ধরা হয় বিদ্যুৎ উৎ পাদনের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পথ। ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ এর থেকে হয় না বলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সামাল দেওয়ার জুতসই পন্থা হিসেবে এটাকে গণ্য করা হলেও অন্যদিকে আবার অসাবধানবশত কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেখা দেওয়া দুর্ঘটনার মুখে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সম্ভাবনা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎ পাদন-প্রক্রিয়াকে যে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে প্রায় তিন দশক আগের চেরনোবিল দুর্ঘটনা। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎ পাদন প্রক্রিয়ার ওপর চেপে বসা চেরনোবিলের ভূতকে যে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি, জাপানের শুক্রবারের ভূমিকম্প মনে হয় সেই বিষয়টিকে আবারও সামনে নিয়ে আসছে।
তবে তার পরও জাপানের যে বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তা হলো, পারমাণবিক বিদ্যুতের বিকল্প জাপানের সামনে এখন নেই বললেই চলে। দেশের মোট চাহিদার ৩০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ আসছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে। সৌর, বায়ু এবং ভূগর্ভের উত্তাপ থেকে তৈরি বিদ্যুৎ ধীরে জায়গা করে নিতে থাকলেও এখন পর্যন্ত সেসব প্রক্রিয়ায় উৎ পাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ হচ্ছে মোট চাহিদার তুলনায় যৎ সামান্য। ফলে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প থেকে লাভ করা শিক্ষা যে নাগরিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত, এই দিকটায় গবেষণা ও উন্নয়নের গতিকে আরও কিছুটা ত্বরান্বিত করবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কেননা, অতীতের শিক্ষা থেকে দেখা গেছে, দুর্যোগের মুখে পড়তে হয়েছে বলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি দক্ষ ও নির্ভরশীল। জাপানে বহুতল ভবন নির্মাণে কাজে লাগানো ভূমিকম্প প্রতিরোধব্যবস্থা হচ্ছে সে রকম একটি দিক, যার চমকপ্রদ সাফল্য সাম্প্রতিক এই ভূমিকম্প অনেক বেশি পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।
শুক্রবারের ভূমিকম্পে জাপানের রাজধানীর বহুতল ভবনঘেরা একটি এলাকার খোলা রাস্তায় ঘটনাক্রমে আমার অবস্থান চমকপ্রদ সেই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিজের চোখে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। ৪০, ৫০ ও ৬০ তলা বিভিন্ন ভবনকে আমি দেখেছি ঝড়ের মুখে পড়া তালগাছ যেভাবে দুলে ওঠে, অনেকটা ঠিক সেভাবে এদিক-সেদিক দুলে উঠতে। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল, এখনই বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে সেসব বিশাল ভবন। কিন্তু না, নড়ে ওঠা কিংবা দুলতে থাকা সত্ত্বেও ঠিকই সেগুলো দাঁড়িয়ে থেকেছে নিজ নিজ অবস্থানে। ভবনে অবস্থানরত লোকজনের অনেকে আতঙ্কিত হয়ে বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ে এলেও তাদের সে রকম আশঙ্কা শেষ পর্যন্ত অমূলক প্রমাণিত হয় এবং জাপানের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অসামান্য সাফল্যের এই দিকটিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। রাজধানী টোকিওতে একটি ভবনও ভূমিকম্পে ধসে পড়েনি। অথচ এ রকম একই মাত্রার ভূমিকম্প এশিয়ার অন্য কোনো বড় শহরে আঘাত হানলে বহুতল ভবনগুলোর মধ্যে কয়টি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, সে রকম প্রশ্ন অবশ্য বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন থেকেই করে আসছেন। বিশেষ করে, ভূমিকম্পের বিস্তার এখন আমাদের বাংলাদেশেও লক্ষণীয় হয়ে ওঠায় আমাদের বেলায়ও বোধ হয় সময় হয়েছে বহুতল ভবন নির্মাণের বেলায় ভূমিকম্প প্রতিরোধকব্যবস্থার বাধ্যতামূলক প্রয়োগ কার্যকর করা। জাপান সেই পথ সহজেই দেখিয়ে দিতে পারে।
এবারের ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যে পথ দিয়ে হয়েছে সেটা হলো ভূমিকম্প-পরবর্তী সুনামি জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেক ঘরবাড়ি আর অন্যান্য সম্পদের পাশাপাশি মানুষকেও। সুনামির আঘাত মোকাবিলার সম্ভাব্য পথ তাই হচ্ছে আরেকটি দিক, যা নিয়ে এখন আবারও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সময়মতো নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার কোনো বিকল্প আদৌ নেই। তবে ভূমিকম্পের বেলায় সরে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় অনেক ক্ষেত্রে খুব কম থাকে বলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। জাপানের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম অবশ্য অভিযোগ করছে যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনকে আগে থেকে কোনোভাবেই সতর্ক করে দেওয়া হয়নি যে ভয়ংকর এক বিপদ তাদের সামনে দেখা দিচ্ছে। তবে সে রকম অভিযোগের যৌক্তিকতাকে অন্যরা আবার এ কারণে খারিজ করে দিচ্ছেন যে ভূমিকম্প নিজে থেকে জানান দিয়ে উপস্থিত হয় না বলে সুনামির বেলায়ও উপকূলে বসবাসরত লোকজনকে সতর্ক করে দেওয়ার সময় হাতে থাকে খুব কম।
এ রকম তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকার মুখে অন্য যে আরেকটি চমকপ্রদ দিক জাপানের এবারের ভূমিকম্প-পরবর্তী অবস্থায় লক্ষ করা গেছে তা হলো, খুবই সুশৃঙ্খলভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনগণের সাড়া দেওয়া। সবাই এখানে একে অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল এবং এমনকি আটকা পড়ে যাওয়া লোকজনের মধ্যেও দেখা দেয়নি বিন্দুমাত্র অসহিষ্ণুতা। সে রকম এক পরিস্থিতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দিন। ভূমিকম্প আঘাত হানার ঠিক পরপর তিনি আটকা পড়েছিলেন উড়ালরেলের মাঝপথে। প্রায় তিনতলা ভবনের সমান উঁচু দিয়ে যাওয়া সেই রেলপথে ভ্রমণরত অবস্থায় হঠাৎ করে প্রচণ্ড দুলুনি তিনি অনুভব করেন এবং ট্রেনটি যাত্রা থামিয়ে দেওয়ার পরও দুলুনি অব্যাহত থাকায় তিনি বুঝে উঠতে সক্ষম হন যে মারাত্মক এক ভূমিকম্পের মুখোমুখি তাঁকে পড়তে হয়েছে। রেলের যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা গেলেও কেউই চিৎ কার কিংবা কান্নাকাটি করে তা জানান দেননি। প্রায় ঘণ্টা খানেক বিরতির পর আবারও আসা ভূকম্পনের আঘাতের মধ্যে ঝুলন্ত সেই রেলপথে আটকে পড়ে থাকা অবস্থায় একসময় তাঁর মনে হয়েছিল জীবনের সমাপ্তি বুঝি আসন্ন। তবে উদ্ধারকারী দল একসময় সেখানে উপস্থিত হয় এবং রেলযাত্রীদের সবাইকে এক এক করে ট্রেন থেকে নামিয়ে পথ দেখিয়ে হাঁটা পথে কাছের স্টেশনে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেখানে অপেক্ষমাণ ছিলেন এবং প্রশাসনিক ভবনে অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি করে নেওয়া অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে যাত্রীদের তাঁরা নিয়ে যান। সেখানেই অন্য জাপানি যাত্রীদের সঙ্গে রাত কাটাতে হয়েছে শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দিনকে। তিনি জাপানিদের মধ্যে আটকা পড়ে যাওয়া একমাত্র বিদেশি হওয়ায় অনেকেই তাঁর প্রতি সহযোগিতার বাড়তি হাত প্রসারিত করে দিয়েছিলেন, যা কিনা তাঁকে মুগ্ধ করেছে।
অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র, রেলস্টেশনের প্রবেশপথ কিংবা অন্য যেখানেই লোকজনকে আটকা পড়তে হয়েছে, সে রকম সব জায়গায়ই এদের মধ্যে ধীরস্থির মনোভাব লক্ষ করা গেছে, যা কিনা পরিস্থিতি মেনে নেওয়াটা অন্য সবার জন্য সহজ করে তোলে। জাপানের লোকজনের দুর্যোগ-পরবর্তী এই আচরণও নিশ্চয় অনুকরণীয় হিসেবে দেখা হবে।
টোকিও, ১২ মার্চ ২০১১
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.