স্যানিটেশন-সুবিধা-যে উদ্যোগ স্কুলে যেতে টানে by মুশফিকুর রহমান

আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়ার হার কমছে—এ খবর অবশ্যই সবাইকে আনন্দিত করে। তবু এ কথা সত্যি, সারা দেশে অসংখ্য শিশু স্কুলে যেতে পারে না। আবার যারা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়, তাদেরও অনেকে স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারে না। ভালো বই, শিক্ষার অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি, ভালো এবং নিবেদিত শিক্ষকের অভাব ছাড়াও অনেক স্কুলের ভালো ঘরদোর ও খেলার মাঠ নেই, পরিষ্কার পানি ও টয়লেট-সুবিধা নেই।


আমাদের শৈশবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাগুলোর অন্যতম আমাদের স্কুল। স্কুলের আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতি পরিণত বয়সেও সবার সঙ্গী। স্কুলের স্মৃতির দিনগুলোর মধ্যে অস্বস্তির মুহূর্ত স্মরণ করতে হলে অনেকের জন্যই স্কুলের টয়লেটের কথা মনে পড়বে। বিশেষভাবে এ কথা মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার-উপযোগী পরিচ্ছন্ন টয়লেট নেই, টয়লেট থাকলেও সেখানে পানি সরবরাহ অনিশ্চিত। ছেলে ও মেয়েদের পৃথক টয়লেট-সুবিধা স্কুলে থাকা আবশ্যিক হলেও অনেক স্কুলেই তা অনুপস্থিত। স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক, ব্যবহার-উপযোগী পরিচ্ছন্ন টয়লেট-সুবিধা থাকলে পুরো স্কুলের পরিবেশ ইতিবাচকভাবে বদলে যায়। আর এর বিপরীত ব্যবস্থায় মেয়েরা সবচেয়ে অসুবিধায় পড়ে। ফলে অনেক মেয়েই স্কুলে অনুপস্থিত বা অনিয়মিত আসা-যাওয়ার দলে যোগ দেয়। তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। অনেকের জন্য শেষ পর্যন্ত স্কুল থেকে ঝরে পড়া অবধারিত হয়।
স্বাস্থ্যসচেতন জীবন পরিচালনার জন্য ছেলেমেয়েদের সচেতন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাড়ির পরিবেশ, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের ভূমিকা, স্কুলের সামগ্রিক পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও স্বাস্থ্য শিক্ষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েদের জন্য বিষয়গুলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা ভালো, স্কুলে শেখা স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ও পরিচ্ছন্নতার ধারণা শিশুরা বয়ে নিয়ে যায় তার পরিবার ও পরিবেশে। শিশু যদি শেখে কীভাবে খাবার আগে, টয়লেট ব্যবহারের পরে কীভাবে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হয়, স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহারের সুফল কী, স্বল্প খরচে কীভাবে স্যানিটারি পায়খানা তৈরি করা যায়, পরিবেশ কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা যায়; তাহলে লেখাপড়া শেখার যৌক্তিকতা তার ও পরিবেশের সবার জন্যই অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে।
স্কুলের ১৪৫ জন ছাত্র ও ১১০ জন ছাত্রীর লেখাপড়ার ভালো ফল এবং নিয়মিত উপস্থিতির ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক ও পরিচ্ছন্ন টয়লেট-সুবিধা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, এ কথা জোর দিয়ে আমাদের জানালেন ঢাকার কাপাসিয়া উপজেলার পিরিজপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল আমিন।
একই স্কুলের শিক্ষক মতিউর রহমান খান জানালেন, তাঁদের স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য নির্মিত পৃথক টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখতে সব শিক্ষক ও ছাত্রকে প্রতি মাসে দুই টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। সেই টাকা দিয়ে টয়লেট পরিচ্ছন্ন রাখার খরচ, সাবান ও টয়লেট টিস্যু কেনা হয়। সবাই অংশ নেয় বলে কারও জন্য স্কুল পরিষ্কার রাখতে সমস্যা হয় না এবং প্রয়োজনীয় তহবিল সহজে সংগৃহীত হয়। শিক্ষক মতিউর রহমান খান আরও জানালেন, তাঁর স্কুলের শিশুরা কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধারণা বাড়িতে সঞ্চারণ করতে সমর্থ হয়েছে। স্কুলে ও বাড়িতে মানসম্মত স্যানিটারি পায়খানা গড়ে ওঠায় পুরো পরিবেশ কেমন বদলে গেছে।
পিরিজপুর স্কুলের ছেলেমেয়ে ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, স্কুলসংলগ্ন গ্রামের পরিবেশে স্বাস্থ্যসচেতন জীবন পরিচালনার তাগিদ তৈরি হয়েছে। কাপাসিয়ার পিরিজপুর ও আশপাশে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের স্যানিটেশন ও হাইজিন নিয়ে তৎপরতা বেশ চোখে পড়ে। ব্র্যাক স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, মসজিদের ইমাম ও দরিদ্র মানুষের দুজন প্রতিনিধি নিয়ে গ্রাম কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ কমিটি নিজেরা মাঝেমধ্যে বসে গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও তার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলোচনা করে—কোন বাড়িতে স্যানিটারি পায়খানা নেই বা থাকলেও তাতে ‘ওয়াটার সিল’ আছে কি নেই, দুর্গন্ধ ছড়ায় কি না, কে টাকার অভাবে স্যানিটারি পায়খানা তৈরি করতে পারছে না ইত্যাদি। যাদের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য আছে, গ্রাম কমিটির সুপারিশে ব্র্যাক তাদের স্যানিটারি পায়খানা তৈরির জন্য ঋণ দেয়। হতদরিদ্রদের নিজ শ্রমে বসতভিটায় স্যানিটারি পায়খানা তৈরির শর্তে এককালীন অনুদান হিসেবে স্যানিটারি পায়খানা তৈরির উপাদানগুলো সরবরাহ করে।
সারা দেশে ২০০৯ সালের তথ্যানুযায়ী, শতভাগ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-সুবিধা রয়েছে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারে। এর মধ্যে শহরে ৫৮ ও গ্রামে ৫০ শতাংশ। ১৯৯০ সালে দেশে মাত্র ২১ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-সুবিধা ভোগ করত। বাড়িতে একটি মানসম্মত স্যানিটারি পায়খানা নিরাপত্তা, স্বচ্ছন্দ, গোপনীয়তার অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। এখানে কেবল পরিবারের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা-সুবিধা তৈরি ও ব্যবহার নয়, কোনো পরিবারে স্যানিটারি পায়খানা-সুবিধা না থাকলে সেই পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতেও মানুষ এখন অনাগ্রহী।
একটা সময় ছিল যখন স্যানিটারি পায়খানা তৈরির জন্য অনেক ঝক্কিতে পড়তে হতো। এখন ব্যাপারটি খুবই সোজা। পিরিজপুর গ্রামের যে কেউ রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা ’কিরণ স্যানিটারি সেন্টার’ থেকে ১৯৭৭ টাকা দিয়ে স্যানিটারি পায়খানা তৈরির জন্য ছয়টি রিং, ওয়াটার সিলসহ স্যানিটারি প্যান বসানো, কংক্রিটের স্লাব, চারটি বেড়া, একটি ছাউনি চালা, পানির পাত্র, সাবান কেসসহ একটি সাবান কিনতে পারে। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তিনটি রিংয়ের ওপর স্লাব ও বেড়া দিয়ে দ্রুতই বানিয়ে ফেলা যায় একটি আধুনিক ও নিরাপদ স্যানিটারি পায়খানা। যদিও তিনটি রিং হলেই একটি স্যানিটারি পায়খানা তৈরি সম্ভব, কিন্তু পাশাপাশি দুটো কুয়া তৈরির উপাদান থাকলে দীর্ঘস্থায়ী স্যানিটারি পায়খানা তৈরি সম্ভব হয়; বিশেষত গরিব মানুষের জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
‘কিরণ স্যানিটারি সেন্টার’-এর মালিক কিরণ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ব্র্যাকের কাছে। কেবল কিরণ একা নন, আরও অনেকে। রাস্তার পাশেই কিরণের ’কারখানা’। কিরণ স্যানিটারি পায়খানা তৈরির পুরো সেট নির্মাণ ও বিক্রি করেন। ইটের খোয়া, বালু, সিমেন্ট পরিমাণমতো পানিতে মিশিয়ে তৈরি ‘মসলা’ নির্দিষ্ট ‘ডাইসে’ স্টিলের মোটা তারসহ ঢেলে নিজে তৈরি করেন কংক্রিট রিং, স্লাব। কংক্রিট স্লাবের মাঝখানে বসানো হয় প্লাস্টিকের প্যান, তার সঙ্গে ‘ওয়াটার সিল’। মাটির গর্তে তিনটি কংক্রিট রিংয়ের ওপর ‘ওয়াটার সিল’ লাগানো প্যানসহ স্লাব বসিয়ে চারপাশে চারটি খুঁটি ও বেড়া ও ওপরে চালা দিয়ে তৈরি হয় একটি স্যানিটারি পায়খানা।
বাংলাদেশের অনেক গ্রামেই এখনো খোলা পায়খানা থেকে বর্জ্য পার্শ্ববর্তী জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। দেশে পানিবাহিত রোগ এবং খোলা পায়খানা থেকে ছড়িয়ে পড়া দূষণ এখনো বড় সমস্যা। গবেষণা থেকে প্রমাণিত যে, স্যানিটেশন-সুবিধা সমপ্রসারণ করা গেলে শিশু মৃত্যু হ্রাস পায়, রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ে, দারিদ্র্য কমে এবং টেকসই পরিবেশের নিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিশেষত দরিদ্র মানুষ, পরিবারের নারী ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পরিষ্কার পানির প্রাপ্যতা ও স্যানিটেশন-সুবিধার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
দেশে ২০১৩ সালের মধ্যে শতভাগ স্যানিটেশন-সুবিধার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার অন্যতম উদ্দেশ্য—কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ না করে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি পায়খানা তৈরি ও সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, উন্নততর স্বাস্থ্যসম্মত জীবনব্যবস্থাকে জীবনের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন-সুবিধা কেবল নিরাপদ ও পরিবেশসম্মত জীবনের প্রয়োজনে নয়, মানবাধিকার ও আনন্দময় জীবনের জন্যও অপরিহার্য। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন পাওয়ার অধিকারকে বাংলাদেশ জাতীয় স্যানিটেশন কৌশলপত্র ২০০৫-এ মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন পাওয়ার অধিকার বাস্তবায়নে মানুষ এগিয়ে আসছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশ বিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.