কালান্তরের কড়চা : এবারের বঙ্গদর্শন (৪)-'সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

গত মাসের (মার্চ) ৫ তারিখে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে আমার বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে একটি মধ্যাহ্ন ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি একজন নগণ্য মানুষ, সাধারণ কলমজীবী। তবু আমার সঙ্গে মানুষকে সম্মান জানাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাব_বিশেষ করে ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট খোন্দকার রাশেদুল হক মহানগরীর সব শ্রেণীর বিশিষ্ট


ব্যক্তিদের নিয়ে এমন এক বিশাল ভোজসভার আয়োজন করায় বিব্রত বোধ করেছি। আবার মনে মনে খুশি হয়েছি এই ভেবে যে দীর্ঘকাল দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি এমন বন্ধুবান্ধব ও বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা হবে।
ভোজসভাটি যে এত বিশাল হবে তা আগে ভাবিনি। অসংখ্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী (তাদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং জি এম কাদেরও ছিলেন), বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ অফিসার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ঢাকার প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদক (নিরপেক্ষতার ভেকধারী দুই পালের গোদা সম্পাদক ছাড়া), বিশিষ্ট আইনজীবী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, কূটনীতিক আলোকচিত্রশিল্পী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও বহু শিক্ষক-শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন।
আটরশির পীর সাহেবের মেজ ছেলে পীরজাদা মোস্তফা আমির ফয়সালও এসেছিলেন ভোজসভায়। তাঁর পাশে বসে কিছুক্ষণ আলাপের সুযোগ পেয়েছি। দেখলাম তিনিও ট্রাডিশনাল পীর বা পীরজাদা নন; উচ্চশিক্ষিত, সদালাপি এবং ধর্মীয় চিন্তাভাবনায়ও একজন আধুনিক সংস্কার-সচেতন মানুষ। অফিসার্স ক্লাবের এই ভোজসভার বিবরণটা এত ঘটা করে দিলাম এ জন্য, যে সম্মান আমার প্রাপ্য নয়, এবার দেশে গিয়ে সেই সম্মান আমি পেয়েছি। মনে মনে গান গেয়েছি_
'ধন্য আমি জন্মেছি মা
তোমার ধূলিতে,
জীবনে-মরণে আমি
চাই না ভুলিতে।'
এই ভোজসভায়ই দেখা দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে। বহু বছর যাবৎ তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয়। তিনি লন্ডনে এলে বা আমি দেশে গেলে দেখা-সাক্ষাৎ হবেই। তাঁকে আমি আইনজীবী হিসেবে এবং মানুষ হিসেবেও খুবই পছন্দ করি। তিনি আমার বয়সে ছোট, নইলে বলতাম শ্রদ্ধাও করি। বহু বছর আগে ব্যারিস্টার শামসুদ্দীন চৌধুরীর (বর্তমানে বিচারপতি) মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। বিলাতের বাঙালি আইনজীবীরা তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য একটি সভা করেছিলেন। সেই সভায় দেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং তৎকালীন বিএনপি সরকারের অপশাসন সম্পর্কে তাঁর জোরালো এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমি আশা প্রকাশ করেছিলাম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি আইনমন্ত্রী হবেন।
সেই মানুষটি ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের গুড বুকে আর রইলেন না। কারণ দেশ ছেড়ে এই সময় তিনি বিদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেন চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে পরবর্তীকালে তাঁর বক্তব্য না শুনেই তাঁকে দূরে ঠেলে দেয় আওয়ামী হাই কমান্ড। ওয়ান-ইলেভেনের সেই দুঃসময়ের কালে লন্ডনে এক কমন বন্ধুর বাসায় বসে তাঁর দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার নেপথ্য কাহিনী তাঁর মুখে আমি শুনেছি। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সামরিক কর্তাদের ভয়ে দেশ ছাড়েননি। একটি পারিবারিক বাধ্যবাধ্যকতার মুখে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। আমার কাছে তাঁর অসত্য বলার দরকার ছিল না। আমি তাঁকে তখন বিশ্বাস করেছি এবং এখনো করি। আওয়ামী লীগ হাই কমান্ডের কেউ কেউ এ জন্য আমার ওপর ক্ষুব্ধ।
আমার একটি ধারণা, সঠিক কি না জানি না, আওয়ামী লীগে স্নায়ুযুদ্ধের আমলের আমেরিকার ম্যাকার্থিজমের ভূত বেশ শক্ত অবস্থানে আছে। আমেরিকায় এই ভুলের রোষানলে পড়েছিলেন হাওয়ার্ড ফাস্টর মতো বরেণ্য সাহিত্যিক এবং চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিশ্বখ্যাত অভিনেতাও। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের ম্যাকার্থিবাদের ভূত ঢুকতে পারায় সামান্য সন্দেহের বশে অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী দলের 'অভয়াশ্রম' থেকে বহিষ্কৃত। যদিও তাঁরা অনেক আওয়ামী নেতার চাইতে অনেক বেশি নীতিবান এবং বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অনুসারী। কিন্তু কে কার কথা শোনে?
এবার আমি ঢাকায় পেঁৗছতেই আওয়ামী লীগের যেসব বন্ধু রোকনউদ্দিন মাহমুদের প্রতি আমার আস্থা ও সমর্থনের কথা জানেন, তাঁরা আমাকে দেখেই মুচকি হেসে বলেছেন, আপনার রোকনউদ্দিন মাহমুদ তো ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে তাঁর আইনজীবী হিসেবে সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এখনো আপনি তাঁকে পছন্দ এবং বিশ্বাস করেন?
বলেছি, বিশ্বাস করি। আমি প্রমাণ পেয়েছি, তিনি একজন সেক্যুলার রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষ। তিনি সাম্প্রদায়িক নন এবং বিএনপিঘেঁষা আইনজীবীও নন। কিন্তু একজন পেশাদার আইনজীবী হিসেবে ড. ইউনূসকে মক্কেল হিসেবে তিনি গ্রহণ করতেই পারেন। ড. ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এটা রাজনৈতিক মামলা নয়। অর্থনৈতিক নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করা সম্পর্কে একটি আইনি লড়াই। এই মামলায় ড. ইউনূসের মতো একজন নোবেলজয়ী বিখ্যাত মানুষ একজন আইনজীবী পেতে পারেন না? আইনজীবী হিসেবে তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো তো তাঁকে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়া নয়। একজন খুনের আসামিরও একজন আইনজীবী পাওয়ার অধিকার থাকে। এই আসামি কোনো আইনজীবী সংগ্রহ করতে না পারলে সরকার তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে। উদ্দেশ্য, কেউ যেন বিনা বিচারে শাস্তি না পায়। এ ক্ষেত্রে ড. ইউনূস তো নোবেলজয়ী, বিশ্ববিখ্যাত মানুষ। তিনি দেশের আইনের ঊধর্ে্ব নন। কিন্তু দেশের আইন অনুযায়ীই নিজের পক্ষে সমর্থনের জন্য একজন আইনজীবী (যেকোনো রাজনৈতিক মতের) তিনি নিয়োগ করার অধিকার রাখেন।
এই প্রসঙ্গে এক আওয়ামী বন্ধুকে একটি গল্প বলেছি। মিস্টার জিন্নাহ যখন বোম্বে (মুম্বাই) হাইকোর্টে একজন আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস করেন এবং মুসলিম লীগের নেতা, তখন এক ধনী মুসলিম লীগ নেতার বিরুদ্ধে তাঁর হিন্দু প্রতিবেশী জমিজমা-সংক্রান্ত একটি মামলা নিয়ে উচ্চ আদালতে যান এবং জিন্নাহকে তাঁর আইনজীবী নিয়োগ করেন। জিন্নাহকে তাঁর দলীয় সহকর্মীরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি নিজের দলের নেতার বিরুদ্ধে মামলায় এক হিন্দু জমিদারের পক্ষ নিলেন? জিন্নাহ জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি এখানে একজন আইনজীবী। রাজনৈতিক নেতা নই। কোনো আইনজীবী দলমত বিচার করে মক্কেল নিতে পারেন না। নিলে দেশে আইন তার নিজস্ব ও নিরপেক্ষ পথে এগোতে পারবে না।'
এ কথা বলতেন ব্রিটেনের সাবেক লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী বিখ্যাত আইনজীবী চেরি ব্লেয়ারও। টনি ব্লেয়ার যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁর স্ত্রী আইনজীবী হিসেবে ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে শিল্পপতিদের মামলায় শিল্পপতি তথা কলকারখানার মালিকদের মক্কেল হিসেবে গ্রহণ করতেন। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হয়ে তিনি বলেছেন, অবশ্যই আমি লেবার পার্টির শ্রমনীতি ও শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থক। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে রাজনৈতিক বিবেচনায় মক্কেল বিচার করতে পারি না।
আওয়ামী বন্ধু আমার মুখে এই গল্প শুনে বলেছেন, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদের ক্ষেত্রে আপনার এই উদাহরণ না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু ড. কামাল হোসেনও কি রাজনৈতিক বিবেচনার ঊধর্ে্ব উঠে নিরপেক্ষ একজন আইনজীবী হিসেবে ড. ইউনূসের মামলা গ্রহণ করেছেন? জবাব দিয়েছি, এই ব্যাপারে আমারও সন্দেহ আছে। প্রথমত, ড. কামাল হোসেন যখন তাঁর রাজনৈতিক দল গণফোরাম গঠন করেন, তখন তাঁকে সাপোর্ট দিতে ড. ইউনূস তাঁর সভা মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আবার ড. ইউনূস যখন ওয়ান-ইলেভেনের সময় নোবেল প্রাইজ পাওয়ার দম্ভে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য ফাল দিয়ে উঠেছিলেন, তখন আবার তাতে ড. কামালের সমর্থনের কথা জানা গিয়েছিল। তাঁদের রাজনৈতিক লক্ষ্যও যে প্রায় অভিন্ন, তা ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওই সরকারকে এবং মাইনাস টু থিওরিকে (যা আসলে তাঁদেরই থিওরি) সমর্থন দান থেকেই বোঝা গিয়েছিল।
সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসের অপসারিত হওয়ার মামলায় ড. কামাল হোসেনের এগিয়ে আসা কাকতালীয় ব্যাপার নাও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ওয়ান-ইলেভেনের সময় নানা দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে শেখ হাসিনা যখন সাবজেলে বন্দি, তখন তাঁর পক্ষে মামলা গ্রহণে যে কারণ দর্শিয়ে ড. কামাল হোসেন অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলে জানা যায়, সেই কারণেই তিনি ড. ইউনূসের মামলাও গ্রহণ করতে পারেন না। তবু করেছেন। এখানেই তাঁর স্ববিরোধিতা।
আপাতত এই প্রসঙ্গ থাক। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত মামলার মতো বিরাট জাহাজের ব্যাপারে আমার মতো আদার ব্যাপারি কী করে জড়িয়ে পড়েছিলাম সেই কাহিনী এখানে বলি। আগেই বলেছি, ৫ মার্চ ছিল ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে আমাকে দেওয়া এক সম্মাননা ভোজ। এই ভোজে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদও এসেছিলেন। ভোজপর্ব শেষে তিনি এক ফাঁকে আমাকে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আমি ড. ইউনূসের মামলায় তাঁর পক্ষের একজন ল'ইয়ার। বললাম, জানি। রোকনউদ্দিন বললেন, আমি কেন তাঁর পক্ষে মামলা গ্রহণ করেছি সে কথা আপনাকে পরে জানাব। আমার ইচ্ছা, আদালতের বাইরে এই মামলার একটা সম্মানজনক মীমাংসা হয়ে যায়_এ ব্যাপারে আপনাকে একটা ছোট্ট ভূমিকা নিতে হবে।
বিস্মিত হয়ে বলেছি, একদিকে একটি দেশের সরকার, অন্যদিকে ড. ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী বিশ্ববিখ্যাত মানুষ, এই দুইয়ের মধ্যে আমার মতো পিপীলিকার স্থান কোথায়? রোকনউদ্দিন বললেন, আপনি পিপীলিকা কি না সে বিতর্কে যাব না। তবে আপনাকে যে কাজটি করতে হবে সে কাজটি কী, তা বলার জন্য আপনার সঙ্গে আজ রাতেই বসতে চাই। কারণ আগামীকালই এই মামলায় হাইকোর্ট বেঞ্চের রায় দেওয়ার কথা। এই রায় হওয়ার আগেই কাজটি আপনাকে করতে হবে।
বলেছি, কথা শোনার জন্য তাহলে আপনার বাসায় আসি! তিনি বললেন, না, আমিই আপনার কাছে আসব। আপনি কার বাসায় উঠেছেন? বলেছি, এবার কারো বাসায় উঠিনি। বনানীতে ইস্টার্ন রেসিডেন্টস নামের একটি হোটেলে উঠেছি। রোকনউদ্দিন হোটেলের ঠিকানাটা নিলেন। বললেন, 'আপনি সন্ধ্যা ৭টা-৮টার দিকে হোটেলের রুমে থাকবেন।' আমি রাজি হয়েছি।
সেই সন্ধ্যায় আমার বন্ধু, সহপাঠী এবং সাবেক জাঁদরেল সচিব মোকাম্মেল হক (জাতীয় কবি মোজাম্মেল হকের ছেলে) আড্ডা মারার জন্য আমার হোটেল রুমে হাজির (তিনি সেক্যুলার রাজনীতি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী এবং কিছুকাল আগে আওয়ামী লীগ নেত্রীর প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন। তবে বর্তমানে নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সরে এসেছেন)। আমরা চুটিয়ে গল্প করছি। প্রসঙ্গ সেই একই_ইউনূস-বিতর্ক। ঢাকায় তখন ইউনূস-বিতর্কই তুঙ্গে। সর্বত্র গুজব, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাধা দেওয়ার জন্য মার্কিন নৌবাহিনী যেমন এগিয়ে এসেছিল, তেমনি এবার বাংলাদেশের একজন মাত্র মানুষের আইনি বিচারকেও বাধা দেওয়ার জন্য মার্কিন কূটনীতিকবাহিনী মার মার রব তুলে এগিয়ে আসছে।
মোকাম্মেল হক ও আমি সব ঘটনা নিয়েই আলোচনা করছিলাম। আমাদের দুজনেরই ধারণা, ড. ইউনূস মোটেই গরিবের বন্ধু নন, তাঁর পেটে পেটে 'চাটগাঁর সওদাগরি বুদ্ধি' যথেষ্ট আছে। তাঁকে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার পেছনে বিদেশি স্বার্থের উদ্দেশ্যমূলক ভূমিকাও আছে। তাঁর বহুদিন আগে স্বেচ্ছায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অবসর নেওয়া উচিত ছিল। সেটা তিনি করেননি। এখন তাঁকে সরানোর বিলম্বিত পন্থা সরকার গ্রহণ করেছে। এটা আইনি লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই ভালো হতো। আদালত রায় দেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নিজে ড. ইউনূস সম্পর্কে মন্তব্য করে, নিজের ছেলেকে সেই বিতর্কে জড়িয়ে ভালো করেননি। ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক ভিকটিম সাজিয়ে এবং তাঁর সমর্থক একট সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে বিষয়টিকে রাজনৈতিকীকরণের সুযোগ করে দিয়েছেন।
আমরা এসব আলোচনাই করছি। এমন সময় ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ এসে হাজির হলেন। মোকাম্মেল হককে সরে যেতে হলো না। তিনি তাঁর সামনেই সরাসরি বললেন, ড. ইউনূস-সংক্রান্ত মামলায় তিনি (রোকনউদ্দিন) আদালতের বাইরে একটা সম্মানজক নেগোসিয়েটেড নিষ্পত্তি চান। তিনি তাঁর মক্কেলকে সেই পরামর্শই দিয়েছেন। কিন্তু এই নিষ্পত্তির জন্য সময় দরকার। এদিকে আগামী দুই-এক দিনের মধ্যেই এই মামলায় হাইকোর্টের রায় দেওয়ার কথা। এই রায় দেওয়ার আগেই ড. ইউনূস আদালতে সময় চাইবেন। সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল আপত্তি না জানালে আদালত সময় দেবেন। এই সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ আলোচনায় বসে একটা নিষ্পত্তিতে পেঁৗছবে।
রোকনউদ্দিন আমাকে বললেন, 'এই ব্যাপারে আপনার ভূমিকা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো, অ্যাটর্নি জেনারেল যেন আদালতে এই সময় আপত্তি না জানান।' আমি বলেছি, এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৌড়াবেন কেন? আইনমন্ত্রীকে তো কথাটা জানালেই হয়। তাঁকে বললেই বোঝা যাবে এই ব্যাপারে সরকারের মনোভাবটা কী।
রোকনউদ্দিন রাজি হলেন। তাঁর সামনে তাৎক্ষণিকভাবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিককে তাঁর বাসায় টেলিফোন করলাম। তিনি একজন ভদ্র, অমায়িক ও আইনজ্ঞ মানুষ। আমার কথা শুনে বললেন, আমরাও চাই ড. ইউনূসের মতো একজন সম্মানিত মানুষের সম্মানহানি না ঘটিয়ে আদালতের বাইরে একটা সম্মানজনক মীমাংসায় যেতে। আমাকে আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে জানাবেন, ড. ইউনূসের আইনজীবী আদালতে সময় চাইবেন কি না। আমি তাহলে সরকার পক্ষ যাতে আপত্তি না তোলে, তার ব্যবস্থা করে দেব।
খুশি মনে সেদিন আমরা তিনজন শুভরাত্রি জানিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। পর দিনও হালকা মনে ঘুম থেকে জেগেছি, যাক ড. ইউনূসের মামলার বিব্রতকর অধ্যায়টা শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু হরিষে বিষাদ! সকাল ১০টার আগেই ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ আমাকে মোবাইল ফোনে জানালেন, তিনি এখন গাড়িতে। হাইকোর্টে যাচ্ছেন। ড. ইউনূস আদালতে সময় চাইবেন না। তিনি চান, সরকার আগে তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং সরকার নিযুক্ত নতুন ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোজাম্মেল হোসেনকে অপসারণের ব্যবস্থা করুক। বললাম, সরকার যদি ড. ইউনূসের সব দাবি আগেই মেনে নেয়, তাহলে আদালতে সময় নেওয়া কেন, আর আলোচনা বৈঠকে বসে মীমাংসা করার বিষয়টাই বা কি আর বাকি থাকে?
বুঝলাম এ ব্যাপারে রোকনউদ্দিন মাহমুদের সদিচ্ছা কাজ করেনি। তিনি তাঁর মক্কেলের ইচ্ছাটাই মাত্র আমাকে জানাচ্ছেন। মক্কেল হয়তো ইতিমধ্যে সিগন্যাল পেয়ে গেছেন। তাঁকে সমর্থন দিতে মার্কিন কূটনীতিক বহর এগিয়ে আসছে। তাই জোর গলায় বলতে পারছেন, 'সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার।' ড. ইউনূস-সংক্রান্ত মামলায় আমার ছোট্ট ভূমিকা এখানেই শেষ।
(পরবর্তী অংশ আগামী মঙ্গলবার)

লন্ডন, ৪ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১১

No comments

Powered by Blogger.