কৃষি-কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে by রাজীব কামাল শ্রাবণ

বর্তমানে দেশে যতটুকু কৃষিজমি অবশিষ্ট রয়েছে সেটিও যদি অকৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়ে যায়, তবে আর সেটি কখনও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তাই দরকার সময়ের সদ্ব্যবহার করা। সময় থাকতেই সব ধরনের আগ্রাসন থেকে কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে


দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার এই চাপ গিয়ে পড়ছে মূলত কৃষিজমির ওপর। গ্রামে প্রতিনিয়ত যৌথ সংসার ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এর জন্য ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষিজমি। শহরের আবাসন সমস্যা মেটাতে শহর সম্প্রসারণের যে প্রকল্প গড়ে উঠছে তার জন্য বেছে নেওয়া হচ্ছে কৃষিজমিকে। বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে দেশে একের পর এক শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। আর সেটিও হচ্ছে কৃষিজমির ওপর। যতই দিন যাচ্ছে কৃষিজমির ব্যবহারের হার ততই বাড়ছে। এতে দেশের কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। এভাবে মোট জমির পরিমাণ কমে যাওয়ার দরুন কৃষিকাজে আগের তুলনায় অনেক কম পরিমাণ জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অথচ বর্ধিত জনসংখ্যার কারণে দেশে প্রতিদিনই খাদ্য চাহিদা বাড়ছে। এর ফলে খাদ্যসামগ্রীর দাম বাড়ছে নিয়মিত বিরতিতে। খাদ্যে মূল্যস্টম্ফীতি অন্যান্য বস্তুর মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। সরকারকে খাদ্য আমদানির জন্য প্রতি বছর বিপুল অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। কৃষক বেশি ফসল ফলানোর জন্য সেই জমিতে আগের তুলনায় বেশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার ফসল উৎপাদন খরচ আনুপাতিক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে কাঙ্ক্ষিত শস্যকণার মধ্যে রয়ে যাচ্ছে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষক্রিয়া। জনস্বাস্থ্য পড়ছে হুমকির মুখে। মানুষের স্বাস্থ্য খাতে খরচ এ কারণে বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ।
কৃষিকাজে কৃষিজমির ইচ্ছামতো ব্যবহার হলেও এ সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা, আইন বা বিধিনিষেধ ছিল না; যতটুকু ছিল তারও কোনো বাস্তবায়ন এ দেশে কখনও হয়নি। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র ০.০৫ হেক্টর। প্রতি বছর এক শতাংশ হারে আবাদি জমি কমছে বলে ধারণা করা হলেও বাস্তবে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৩ শতাংশ এবং ২০০৫ সাল থেকে ৫ শতাংশ হারে কমছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ হার আরও অনেক বেশি। তবে সুখের বিষয় হচ্ছে, দেরি করে হলেও সরকার কৃষিজমি ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভূমি ব্যবহার আইন প্রণয়ন করছে, যাতে কৃষিজমির যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ হয়। আইনটিতে বলা হয়েছে, কোনো কৃষিজমি আবাসন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পাশাপাশি জমি হস্তান্তর, পতিত জমির ব্যবহারের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করার ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে কৃষিজমির পরিমাণ কমে না যায়। পরপর তিন বছর কোনো জমি পতিত পড়ে থাকলে সে জমি সরকার অধিগ্রহণ করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করবে। ইতিমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না মর্মে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের জন্য ভূমি ব্যবহার আইন যে কতটা সময়োপযোগী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আরও আগেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে প্রথমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। তা হচ্ছে_ ১. দেশের অবশিষ্ট কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার রোধ ও দূষণমুক্ত রাখা। ২. নতুন কৃষিজমির উৎস খুঁজে বের করা।
প্রথম বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। মানুষ যাতে কৃষিজমি অকৃষিকাজে ব্যবহার না করে সে ব্যাপারেও সরকারের কিছু সহায়ক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাই গ্রামে আবাসন ব্যবস্থা যাতে ইচ্ছামতো কৃষিজমিতে গড়ে না ওঠে সে জন্য স্থানীয় সরকারের কঠোর নজরদারির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি গ্রাম উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্রাম পর্যায়েও যতটা সম্ভব কম নতুন বাড়ি তৈরি করে স্বল্পব্যয়ে দ্বিতল বা ভূমির ঊর্ধ্বমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করলে কৃষিজমিতে মানুষের বাড়িঘর নির্মাণের প্রবণতা হ্রাস পাবে। এ ক্ষেত্রে সরকার সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য কোন ধরনের জমি ব্যবহার করা যাবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। শিল্পায়ন উপযোগী জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সেখানে এসব স্থাপনা নির্মাণে উৎসাহিত করতে হবে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটালে শিল্পোদ্যোক্তারাও এ ব্যাপারে উৎসাহিত হবেন। এসব কারখানার বর্জ্য যাতে কোনোভাবেই কৃষিজমিতে গিয়ে না পড়ে সেটিও অত্যন্ত কঠোরভাবে এ আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। প্রতিটি শিল্পকারখানায় অবশ্যই বর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা উচিত। ইটভাটা তৈরি না করে ইটের বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কৃষিজমি রক্ষায় সরকারের প্রচেষ্টা ও জনগণের অংশগ্রহণের সমন্বয় ঘটবে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটি বাস্তবায়ন করা সহজ ও দ্রুততর হবে। এ ছাড়াও দেশের যে এলাকায় যে ধরনের ফসল ভালো জন্মে তার সঠিক তথ্য বিবরণী নিশ্চিত করে সেসব এলাকায় সে ধরনের ফসল উৎপাদনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা উচিত। এতে কৃষিজমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ নতুন কৃষিজমির উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এখনও দেশের যেসব অঞ্চলের পতিত জমি কৃষিকাজে ব্যাহত হয় না তা চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু বর্তমানে দেশে যতটুকু কৃষিজমি অবশিষ্ট রয়েছে সেটিও যদি অকৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়ে যায়, তবে আর সেটি কখনও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তাই দরকার সময়ের সদ্ব্যবহার করা। সময় থাকতেই সব ধরনের আগ্রাসন থেকে কৃষিজমির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

রাজীব কামাল শ্রাবণ : শিক্ষার্থী শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.