ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর-চাই সমতাভিত্তিক সৌহার্র্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক

সপ্তাহ খানেক আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের পত্রপত্রিকায় আলোচনার ঝড় উঠেছিল। কেউ কেউ ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন সংলাপ এবং সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার সফর বিতর্ককে খুব বেশি পল্লবিত


হতে দেয়নি। বরং দু'দেশের সম্পর্ক এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে উষ্ণ, সৌহার্দ্য, আন্তরিকতা ও প্রতিশ্রুতিতে অভিষিক্ত। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশিত ঢাকা সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার সফরটিকে বলা হচ্ছে অগ্রবর্তী ও প্রস্তুতিমূলক সফর। এসএম কৃষ্ণার সফরের পর দু'দেশের কর্মকর্তারাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও আশা প্রকাশ করেছেন যে মনমোহন সিংয়ের সফরটি 'ঐতিহাসিক' হবে। বলা আবশ্যক, এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরও 'ঐতিহাসিক' বলেই বিবেচিত হয়েছে। সে সময়ে দু'দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ৫০ দফা কর্মসূচি নির্ধারণ করেছিলেন। এই ৫০ দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন দিগন্তে উপনীত হবে এমন আশাবাদ সত্ত্বেও নানা চুক্তির প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নে ধীরগতি অনেক সময়ই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কৃষ্ণার সফরের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দীর্ঘদিনের বিবদমান সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে চুক্তি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দাবির একটি। এক্ষেত্রে ন্যায্য একটি চুক্তি হওয়া উচিত। কৃষ্ণা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সেপ্টেম্বরেই তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন ও সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে চুক্তি হতে পারে। অনিষ্পন্ন সীমানা, করিডোর ও ছিটমহল সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে দু'দেশের অধিবাসীদের ভুগিয়ে চলেছে। এ বিষয়ে ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে সমস্যাগুলোর সমাধান আসতে পারে। ছিটমহলগুলোতে বাংলাদেশের অধিবাসীদের সার্বক্ষণিক ও অবাধ চলাচলও নিশ্চিত হওয়া দরকার। পাশাপাশি, সীমান্তে গোলাগুলি ও সাধারণ মানুষের প্রাণক্ষয় এড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ আসা উচিত। বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অপসারণ করে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ বাড়ানো দরকার। এক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্লথগতির অভিযোগ আছে। আমরা মনে করি, দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য ঘাটতি দ্রুত কমিয়ে আনা দরকার। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সৃষ্টির যে সম্ভাবনার কথা ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন তা এদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করবে। আমাদের বন্দর ব্যবহার করে নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য পরিবহনের যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের বাজারেও একটি সুবাতাস প্রবাহিত হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বাস্তবতা এখনই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলে পণ্য ও পণ্যবাহী যানের অবাধ পরিবহনে বাধা হলো অপ্রস্তুত বন্দর। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কার্যক্ষমতা, আধুনিকায়ন ও বন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেল সংযোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দ্রুতগতিতে কাজ করতে হবে। ট্রানজিট নিয়ে নানা বিভ্রান্তি আছে বাংলাদেশে। সে বিভ্রান্তি এড়াতে চুক্তিগুলো জনসমক্ষে প্রচারিত হওয়া দরকার। অহেতুক বিতর্ক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ঘনীভূত ধূম্রজাল তাতে অপসারিত হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বাধাগুলো অপসারণ করতে হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গেই এগোতে হবে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এসএম কৃষ্ণা বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গেও বসেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতের সঙ্গে চুক্তি সংসদে উত্থাপনের তাগিদ দিয়েছেন। প্রত্যাশিত হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সংসদে উত্থাপনের নজির নেই। তদুপরি সংসদ বর্তমানে বিরোধী দলবর্জিত। তবে বিরোধী দল উদ্যোগ নিয়ে সংসদে ফিরে গিয়ে এমন আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে যখন বিবদমান দেশগুলো রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করছে, আঞ্চলিক জোটগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেন আরও উন্নত হবে না। পারস্পরিক স্বার্থ পূরণে প্রতিবেশী দেশ দুটির আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সমতাভিত্তিক, সহিষ্ণু, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের খোলামেলা সম্পর্কই প্রত্যাশিত। আমরা আশা করি, দু'দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সে সম্পর্কই বাস্তবায়িত হবে।
 

No comments

Powered by Blogger.