একাত্তরের এই দিনে-পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের সমান্তরাল সরকার by আইয়ুব খান

একাত্তরের মার্চে যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত সমগ্র দেশ, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি বাঙালি, তখন এক হাজার ২০০ মাইল দূরে বসে সাবেক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান কীভাবে সেসব ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক কিংবা ভুট্টোর আস্ফাালন—সেসব বিবৃত হয়েছে তাঁর


রোজনামচায়। মাত্র দুই বছর আগে গণ-অভ্যুত্থানে পদচ্যুত, প্রচণ্ড বাঙালিবিদ্বেষী এই শাসক ‘পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছেদকে অবশ্যম্ভাবী’ বলে মনে করেছিলেন। ক্র্যাইগ ব্যাক্সটার সম্পাদিত আইয়ুব খানের রোজনামচা ১৯৬৬-১৯৭২ বইয়ের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন এম এ মোমেন

২০ মার্চ ১৯৭১, শনিবার
শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার সঙ্গে গতকাল আর একটি বৈঠক করেছেন, বের হওয়ার সময় তাঁকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। ঠিক করা ছিল দুই পক্ষের বিশেষজ্ঞরা বসে কোন কোন বিষয়ের নিষ্পত্তি করবেন। ইয়াহিয়ার পক্ষে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, জাস্টিস কর্নেলিয়াস এবং অ্যাডভোকেট জেনারেল অফিসের কোনো এক কর্নেল হাসান। তাঁদের কারোরই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। কাজেই মুজিবুর রহমানকে সন্তুষ্ট করতে তাঁরা যদি এ অঞ্চলের স্বার্থের জলাঞ্জলিও দেন, আমি বিস্মিত হব না। এর মধ্যে ভুট্টো হুমকি দিয়ে বসেছেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ বলি দেওয়া হয় তা হলে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি আসলে যা বলতে চাইছেন তার মানে হচ্ছে, তাঁর ও তাঁর লোকদের ভাগে যদি কিছু না পড়ে তা হলে সমস্যার সৃষ্টি করবেন। ভুট্টোর আশঙ্কা, দৌলতানা ও অন্যরা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যোগ দিয়ে সরকার গঠন করবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য কোনো ভালোবাসা থেকে নয়, তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ যে ক্ষুণ্ন হচ্ছে এ কারণেই তাঁর হূদয়ে এত রক্তক্ষরণ। একটি সামরিক ভাষ্যমতে, জনগণ অস্ত্র-ব্যাপারি ও অন্যান্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সংগ্রহ করেছে এবং তা অবাধে ব্যবহার করে যাচ্ছে। আর স্থানীয় সাংবাদিক সম্প্রদায় কোথাও কোনো গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেই তা সেনাবাহিনী করেছে বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
আমার আশঙ্কা, বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে হলে—তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, কি অনড় তিক্ত সম্পর্কের কারণেই হোক, এই সেনাদের চাপের মুখে গুলিবিনিময় করে বেরিয়ে আসতে হবে। সঙ্গে নারী, শিশু ও প্রচুর গার্হস্থ্য তৈজসপত্র যখন থাকে এমনকি স্থলপথেও সেনা প্রত্যাহার করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে। কিন্তু ভয়াবহ সংকট তখনই সৃষ্টি হয়, যখন যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, চারদিকে অজস্র খাল-বিল-নদীর বাধা ডিঙিয়ে বন্দরে আসতে হয়, সরু জলপথে জলযান বিপন্ন হয়ে পড়ে—গভীর সাগরে না পড়া পর্যন্ত এই বিপন্নতা কাটে না। যদি পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে মোড় নেয়, তাহলে এই সেনাদের জন্য স্থানীয় কমান্ডারদের জরুরি কোনো উদ্ধার পরিকল্পনা থাকবে বলে আমি আশা করি।
নিজ নিজ উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়ার সঙ্গে আর এক দফা বৈঠক করেছেন। মনে হয়েছে, ইয়াহিয়া মুজিবুর রহমানকে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জন উপদেষ্টার একটি বহর নিয়ে ভুট্টো ঢাকার দিকে পা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছেন। ইয়াহিয়ার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং তাঁর কিছু কিছু উত্থাপিত বিষয়ের সন্তোষজনক আশ্বাস পাওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আলোচনার জন্য ব্রোহিকেও ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ওয়ালী খান, দৌলতানা এবং মুফতি মাহমুদ আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থান করছেন। ভুট্টোও পিছিয়ে পড়ে থাকতে চান না। তাঁর উদ্বেগ, অন্য কেউ একটা চাকরি পাওয়ার আগেই তাঁকে পেতে হবে।
এই ক্রান্তিকালে ইয়াহিয়া যদি ধ্বংসাত্মক কোনো সমঝোতা কিংবা মারাত্মক কোনো ভুল করে ফেলেন—তা হলে এটা তাঁর নির্বাহীদের কারণে, যাঁদের তিনি দুর্বল করতে করতে পৌরুষত্বহীনের পর্যায়ে নেমে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে রাজনীতিবিদেরা তাঁকে মেপে ফেলেছেন। এখন তাঁরা কেবল চুক্তির শর্তই বাতলে দিতে পারেন না, চাইলে কেন্দ্রীয় সরকারকে পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো শুইয়ে ফেলতে পারেন; মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে যেমন করছেন—নতুন পরিভাষা অনুযায়ী সমান্তরাল সরকার চালিয়ে যেতে পারেন। আর এর ফলে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছে এবং তারা আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি আত্মরক্ষার সময়ও করজোড়েই তা করতে হচ্ছে। বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে খুদে দোকানদার ও ছোট অপরাধীদের বিচার করা ছাড়া রাষ্ট্রের সুস্থতা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সব উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে এই সেনাবাহিনী—তারা বেসামরিক প্রশাসনের হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাদলের চলাফেরা ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। তারা রাস্তায় ব্যারিকেডের মুখোমুখি হচ্ছে, জনতা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তাদের আক্রমণ করছে। এসবের মোকাবিলা করা খুব কঠিন কাজ নয়, কিন্তু কোনো একটা প্রতিহত করতে গেলে গোটা প্রদেশে প্রচণ্ড চিৎকার শুরু হয়ে যায়। প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং নতি স্বীকার করে। আর এর ফলে সেনাবাহিনীর সম্মান, মনোবল ও খ্যাতি লুটিয়ে পড়ে—মূলত ওপরের দুর্বল ও অবিবেচক নেতৃত্বের কারণে।

No comments

Powered by Blogger.