শেয়ারবাজার প্রতিবেদন-আমি দ্বিমত পোষণ করছি by আ হ ম মুস্তফা কামাল

বহুল প্রচারিত প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিএমসি-কামাল টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের (সিএমসি-কামাল) ‘শেয়ারের দাম দুই বছরে ৭৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে’ প্রতিবেদনটি সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ নয় বলে আমি দ্বিমত পোষণ করছি।


১. আমরা, আমার পরিবারবর্গ ও সাবিনকো (সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, যার ৫০ শতাংশের মালিক সৌদি সরকার এবং বাকি ৫০ শতাংশের মালিক বাংলাদেশ সরকার) উদ্যোক্তা হিসেবে ১৯৯৫ সালে সিএমসি-কামাল টেক্সটাইল মিলটি প্রতিষ্ঠা করি। পুঁজিবাজার থেকে ১৭ লাখ ২০ হাজার সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা করে মোট ১৭ কোটি ২০ লাখ টাকা উত্তোলন করি। আমার পরিবার এবং আমার পারিবারিক বন্ধু মিলে আমাদের মালিকানা মোট পুঁজির ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ, সাবিনকোর ২০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ৩৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠালগ্নে আমাদের উদ্যোক্তা শেয়ারের (সাবিনকো ছাড়া) পরিমাণ ছিল সাত লাখ বা সাত কোটি টাকার। ২০০৩ সালে আমার দুই মেয়ে কাশফি কামাল ও নাফিসা কামালের নামে যথাক্রমে দুই হাজার ৭০০ এবং এক লাখ ২৭ হাজার ৯৮০টি অর্থাৎ এক লাখ ৩০ হাজার ৬৮০টি শেয়ার বাজার থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এসইসির অনুমোদন নিয়ে কিনি। এ ছাড়া বোনাস হিসেবে ৮৩ হাজার ৬৮টি শেয়ার আমাদের হিসাবে জমা হওয়ার পরে ২০১০ সাল ষাণ্মাষিক পর্যন্ত সিএমসি-কামালে আমাদের মোট পুঁজির পরিমাণ দাঁড়ায় নয় কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকা। একইভাবে সাবিনকোর হিসাবেও প্রাপ্ত শেয়ারের সঙ্গে বোনাস শেয়ার যুক্ত হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে সাবিনকো তাদের বোনাস শেয়ার বাজারে বিক্রি করে। আমরাও ২০০৩ সালে কেনা এক লাখ ২২ হাজার ২০০ শেয়ার এবং বোনাস হিসেবে মোট ৬৮ হাজার ৫৫০টি শেয়ার এসইসির অনুমোদন নিয়ে বিক্রি করি। উল্লেখ্য, আইপিও থেকে প্রাপ্ত উদ্যোক্তা শেয়ার আমরা ও সাবিনকো বিক্রি করিনি।
২. প্রতিবেদনে বলেছেন, সিএমসি-কামালের প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০০৮ সালে ছিল ৪০ টাকা। আমরা নিয়মিতভাবে লভ্যাংশ দিইনি। দুই বছর সময়মতো এজিএম করিনি। তার পরও বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই বছরে সিএমসি-কামালের শেয়ারের দাম বেড়েছে ৭৫ গুণ।
সিএমসি-কামাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি ছিল লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কেবল এক বছর আমরা লোকসানে ছিলাম। দুই বছর লাভ থাকা সত্ত্বেও লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি, কারণ সাবিনকোর ঋণ পূর্ণমাত্রায় শোধ না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির সংঘবিধির একক ক্ষমতা বলে পরিচালনা পর্ষদের সভায় সাবিনকো লভ্যাংশ ঘোষণার বিরোধিতা করে। আমরা ২০০৬ সাল থেকে সাবিনকোর ঋণ সম্পূর্ণভাবে শোধ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি এবং ২০১০ সালে সাবিনকো ও সিটি ব্যাংকের সব দেনা শোধ করে দিই, যা আমাদের মূল্য সংবেদনশীল তথ্যেও প্রকাশিত হয়। ফলে আমাদের কোম্পানির মৌলভিত্তি অনেক শক্তিশালী হয়।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমাকে অন্যায়ভাবে প্রায় দুই বছর কারাবন্দী করে রাখে। কোম্পানিটি ছিল প্রায় বন্ধ। এজিএম করা সম্ভব হয়নি। লভ্যাংশ বিতরণ সম্ভব হয়নি। সংগত কারণেই প্রতিটি শেয়ারের দাম তখন ছিল ৪০ টাকা। আমি ২০০৮-এর শেষের দিকে জেল থেকে বের হয়ে কোম্পানিটি পুনরায় চালু করি। তখন থেকেই মুনাফা অর্জনে সক্ষম হই এবং বোনাস হিসেবে লভ্যাংশ প্রদান করি।
২০০৯ এবং ২০১০ সাল ছিল টেক্সটাইল খাতের জন্য একটি সোনালি সময়। এর ধারাবাহিকতায় আমরাও লাভবান হই। ২০০৯-এর শুরু থেকেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মতো আমাদের কোম্পানির শেয়ারের দামও বাড়তে বাড়তে ২০১০ সালের শেষের দিকে এসে অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়ে। এর কারণ হিসেবে আমি মনে করি, আংশিক হচ্ছে বাজারের মৌলভিত্তি আর বাকিটা হচ্ছে চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের অসামঞ্জস্য। ১২ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট দুই বছরে ৩২ লাখ ৭৪ হাজারে উন্নীত হয়েছে। এর বিপরীতে বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়েনি বললেই চলে।
প্রতিবেদনে সিএমসি-কামালের শেয়ারের দাম দুই বছরে ৭৫ গুণ বৃদ্ধির তথ্যটি হলো, ২০০৮ সালে যখন আমাদের শেয়ারের দাম ৪০ টাকা ছিল, সেটাকে ভিত্তি হিসেবে ধরে। সে সময়টি ছিল আমাদের জন্য একটি অস্বাভাবিক সময়। ওই সময় কোম্পানিটি ছিল প্রায় বন্ধ। সুতরাং ওই সময়ের শেয়ারের দাম ৪০ টাকাকে ভিত্তিমূল্য হিসেবে ধরে অন্য সময়ের সঙ্গে তুলনা করে ৭৫ গুণ বাড়ার যুক্তিটি সঠিক হয়েছে বলে মেনে নেওয়া যায় না।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, কিছু মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের কারণে বাজারে সিএমসি-কামালের শেয়ারের দাম বেড়েছে, যা উদ্দীপক (সুইটেনার্স) হিসেবে কাজ করেছে—এই তথ্যটি মোটেই বস্তুনিষ্ঠ নয়, যা নিচের তথ্য থেকে বোঝা যাবে:
এ থেকে এটাই প্রমাণিত হবে যে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে সিএমসি-কামালের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে এবং সে সময় ডিএসইর সাধারণ সূচকও অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আসল কথা হচ্ছে, ২০০৯ ও ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত সব কোম্পানির শেয়ারের দামই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় টেক্সটাইল খাতের শেয়ারের দামও বাদ যায়নি। সিএমসি-কামালের শেয়ারের দাম অতিমাত্রায় বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে এসইসি আমাদের কোম্পানির শেয়ার লেনদেন প্রায় ১১ দিন বন্ধ রাখে। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি।
যেসব উদ্দীপকের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেগুলো কোম্পানির স্বার্থে বিদ্যমান সব আইন, নিয়মনীতি অনুসরণ করে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে জেলে রাখা এবং পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকার কারণে দুই বছর সময়মতো এজিএম করা সম্ভব হয়নি, যা পরে নিয়মিত করা হয়েছে। কোম্পানির সাধারণ সভায় মুনাফা নিরীক্ষা করে কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। শেয়ার ডিম্যাট এসইসির চাহিদা অনুযায়ী করতে হয়েছে। সুতরাং এসব সংবেদনশীল বিষয় বাস্তবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট যেকোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোয় উদ্দীপক হিসেবে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, এ-জাতীয় উদ্দীপক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মৌলভিত্তি শক্তিশালী করে। কিন্তু এর সঙ্গে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। কোম্পানির এজিএমের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যমান আইন ও নিয়মনীতি অনুযায়ী শেয়ারের অভিহিত মূল্য পরিবর্তন করা হয়। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত প্রায় ৪৫টি কোম্পানি তাদের অভিহিত মূল্য পরিবর্তন করছে। ১৯৯৫ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির জায়গা-জমিসহ অনেক সম্পদই তখনকার দামে মূল্যায়িত হয়ে আসছিল। রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নতুন পুঁজি সংগ্রহের লক্ষ্যে সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়েছে। আর এটিও বিদ্যমান আইন ও নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই করা হয়েছে এবং সম্পদের পুনর্মূল্যায়ন করে কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়নি। রাইট শেয়ার করতে হয় প্রতিষ্ঠানটির বিএমআরই কাজ সম্পন্ন করার জন্য। এবং সেখানে রাইট শেয়ার ইস্যুর জন্য যে প্রিমিয়াম ধরা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠানটির বিএমআরইর চাহিদা মেটাতে এবং কোম্পানির মৌলভিত্তির ওপর ভিত্তি করেই নির্ণয় করা হয়েছে।
৩. প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সিএমসি-কামালের শেয়ারের দর গত দুই বছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আর এই সময়ে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করে বিপুলভাবে লাভবান হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা।’
কিন্তু এখানে বেআইনি বা অনৈতিক কাজটি কী হলো? উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে লক-ইন না থাকলে উদ্যোক্তারা কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন নিয়ে সব সময়ই বাজারে তাঁদের শেয়ার বিক্রির অধিকার রাখেন। আমাদের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমোদন নিয়ে আমরা উদ্যোক্তারা কেবল আমাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ, যা আমাদের মোট শেয়ারহোল্ডিংয়ের মাত্র ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ বাজারে বিক্রি করেছি। যদিও আইনি কোনো বাধা ছিল না। তার পরও আমরা উদ্যোক্তারা আমাদের আইপিওতে প্রাপ্ত প্রাথমিক উদ্যোক্তা শেয়ারের একটিও বাজারে বিক্রি করিনি, যেখানে অনেক উদ্যোক্তাই এ কাজ করেছেন। যদি কাজটি করতাম, তাহলে আমাদের আইপিওতে প্রাপ্ত সাত কোটি টাকার উদ্যোক্তা শেয়ার বাজারে বিক্রি করে বাজার থেকে আমরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা উত্তোলন করতে পারতাম। কিন্তু কাজটি আমরা করিনি।
একজন জনপ্রতিনিধি বা পাবলিক অফিস হোল্ড করে আমি কোনোভাবেই পুঁজিবাজারকে কোনো সময়ই প্রভাবিত করিনি বা করার চেষ্টাও করিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি শুধু সরকারকে পরামর্শ প্রদান করতে পারি, এর বেশি কিছু নয়।
আ হ ম মুস্তফা কামাল: এমপি; পরিচালক, সিএমসি-কামাল টেক্সটাইল মিলস লি.।

প্রথম আলো প্রতিবেদকের বক্তব্য
প্রতিবেদনের প্রতিটি তথ্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। যার প্রায় সবটাই কোম্পানিটির পক্ষ থেকে ডিএসইকে সরবরাহ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনটিতে প্রকাশিত প্রতিটি তথ্যের সঙ্গে আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্য বিশদভাবে ছাপা হয়েছে।
তা ছাড়া প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি, প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারা প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) থেকে প্রাপ্ত উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করেছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরের দুই বছর শেয়ারবাজার চাঙা পরিস্থিতি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেদনটিতে কোম্পানিটির শেয়ারের গত দুই বছরের মূল বৃদ্ধির প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.