চরাচর-মোহাম্মদ সাইদুর : লোকশিল্প চর্চার পথিকৃৎ by স্বপন কুমার দাস

ইংরেজ আমলে সমগ্র বাংলায় লোকশিল্পের প্রথম সচেতন সংগ্রাহক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের পর গত শতকের ত্রিশ দশকে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা গুরুসদয় দত্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে চাকরির সুবাদে লোকশিল্প নিদর্শন সংগ্রহ করেন। তিনি ১৯৪০ সালে চবি্বশপরগনায় একটি লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন।


তাঁরা উভয়ই জাতীয়তাবাদের চেতনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে লোকশিল্প নিদর্শনের সংগ্রাহক ছিলেন। রবীন্দ্র-উত্তর বিভক্ত বাংলায় গত শতকের ষাট ও সত্তর দশকে লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহকারী হিসেবে আরো একজনের নাম প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ সাইদুর। তিনি বাংলা একাডেমীর হয়ে কাজ করেছেন। এ দেশের সাধারণ মানুষের সহজাত সৃজনশীলতা এবং সৌন্দর্যবোধ তাঁকে লোকশিল্প নিদর্শন সংগ্রহে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিশ্ববিখ্যাত লোকশিল্প সংগ্রহক হেনরি গ্লাসি বলেছেন, 'মোহাম্মদ সাইদুরের চোখ দিয়ে আমি বাংলাদেশকে দেখেছি।' মোহাম্মদ সাইদুরের জন্ম কিশোরগঞ্জ সদর থানার চরবগাদিয়া গ্রামে, ২৮ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে। তাঁর বাবা কুতুবুদ্দিন আহমদ ছিলেন পুঁথি পাঠক ও বিখ্যাত গায়েন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় বিদ্যালয়ে। পরে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাইস্কুলে। ওই স্কুলে পড়ার সময় তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। এরপর তিনি কিছুকাল সাংবাদিকতাও করেন। সাংবাদিকতা করার সময়ই তিনি বাংলাদেশের সমৃদ্ধ লোকসাহিত্য ও লোকশিল্পের সন্ধান পান। তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমীতে সংগ্রাহক হিসেবে যোগ দেন। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে গীত, কবিতা, কাহিনী, পুঁথি ও কেচ্ছার কথন ও লেখারূপ সংগ্রহ করে বই আকারে প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জামদানি, বেড়া ভাসান উৎসব, মহররম উৎসব, কিশোরগঞ্জের ইতিহাস ও বাংলা একাডেমী ফোকলোর সঙ্কলন। লোকশিল্প নিদর্শন সংগ্রহেও মোহাম্মদ সাইদুর ছিলেন অদ্বিতীয়। বাংলা একাডেমীর লোকঐতিহ্য সংগ্রহশালা, সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডশন এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তাঁর সংগৃহীত বহু বিরল নিদর্শন রয়েছে। তা ছাড়া তিনি নিজ গ্রাম বিন্নগাঁয়ে একটি লোকশিল্প সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করেন। ফোকলোরবিদ হেনরি গ্লাসি এই সংগ্রহশালা উদ্বোধন করেন। লোকসাহিত্য ও লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহের পাশাপাশি তিনি নিজেকে একজন আদর্শ গাইড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এ দেশের বহু শিক্ষক, গবেষক তাঁর অধীনে কাজ করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বিদেশি গবেষক ও ছাত্রছাত্রী এ দেশের লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করতে এসে সবার আগে খোঁজ করতেন তাঁকে। শুধু জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন ছাত্রছাত্রী ও গবেষক তাঁর গাইডে এ দেশের লোকশিল্প ও লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন। তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমী থেকে অবসর নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্বেচ্ছাকর্মী সংগ্রাহক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। যে সমাজে সংগ্রাহকের সামাজিক মর্যাদা নেই, আর্থিক নিরাপত্তা নেই, কাজের স্বীকৃতি নেই সেখানে মোহাম্মদ সাইদুর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিকে তিনি বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ দেশের জন্য বয়ে এনেছেন বহু সম্মান। গত ৪ মার্চ ছিল এই মহান সংগ্রাহকের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। দেশ-বিদেশে তাঁর অগণিত ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী আজ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন।
স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.