তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভবিষ্যৎ

আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে গেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। তবে এর আওতায় আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদে এ পদ্ধতি সংস্কারের জন্য বলা হয়েছে আদালতের রায়ে।


বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল একটি বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর জোটবদ্ধ দুর্বার আন্দোলনের মুখে যখন বিএনপি সরকার আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা হারায় তখনই '৯০-এর অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। তবে এর আগে ১৯৯০ সালে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করা হলে রিট আবেদনকারী সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। গত মার্চে আপিলের শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে আট সিনিয়র আইনজীবী আদালতে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। তাঁদের বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাইরে রাখার কথা উঠে আসে। এমন এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আদালতের রায় পাওয়া গেল যখন সংবিধান সংশোধন নিয়ে একটি বিশেষ কমিটি কাজ করছে।
এ কথা ঠিক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। ১৯৯৬ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তখন একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সারা দেশে। সেই সময়ের নির্বাচিত সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি একটি সীমিত সময়ের ব্যবস্থা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। তাদের হাতে যে ক্ষমতা থাকে সেটাও সীমিত। কিন্তু বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা দেখেছি, নির্দিষ্ট সময়েরও অনেক বেশি সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। শুধু তাই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না এমন অনেক কাজও করেছে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সংবিধানের অনেক ধারা স্থগিত হয়ে পড়ে। অনেকেই এ ব্যবস্থাকে সামরিক আইনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, তখন নির্বাচন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান অনেক দুর্বল ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্যবধানে নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
আদালতের রায়ে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাইরে রাখতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে পূর্ব-অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। রায়ে আদালতের এ পরামর্শ ধন্যবাদার্হ। বিচারালয়কে সব ধরনের বিতর্কের ঊধর্ে্ব রাখা উচিত। আদালতের রায়ে তেমনটিই বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে আদালতের রায় অত্যন্ত সময়োপযোগী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করা গেলে এবং নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.