ক্লাসঘরের কথা : ২-ড. জেকিল ও মি. হাইড by আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

(পূর্বপ্রকাশের পর) ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। শ্রাবণগগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে, শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি_ যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী সর্বস্ব খোয়ানো রিক্ত নিঃস্ব সান্তিয়াগোর মনেও শেষ মুহূর্তে যেন বেজে চলেছিল কবিতাটির শেষ অংশে কৃষকের ভাঙা কণ্ঠের খিন্ন হাহাকার:


শ্রাবণগগন ঘিরে ঘন মেঘ
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি_
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।


বইটির শেষে একটা মজার গল্প আছে। মাছের কঙ্কালটি যেখানে রাখা ছিল, কিছুদিন পরে সেখানে এলো দুজন টুরিস্ট, একজন তরুণ, একজন তরুণী। চটুল অগভীর এই টুরিস্টরা জানে না কঙ্কালটা একটা মাছের। মেয়েটি কঙ্কালটা দেখে অবাক: 'হাঙরের কঙ্কাল এত বড় হয়'! হায়, ত্বকসর্বস্ব এই টুরিস্টরা বুঝলও না এ কঙ্কাল হাঙরের নয়, মাছের। পৃথিবীর বৃহত্তম, মহত্তম, অপরূপতম মাছের। জানলও না, এই মাছটিকে জয় করার জন্যে একদিন সমুদ্রের বুকে একজন মানুষের দিনের পর দিন কী দীর্ঘ দুঃসহ প্রতীক্ষা, কী অকথ্য নির্মম সংগ্রাম, কী তোলপাড় করা অপার্থিব বিজয় আর নিষ্ঠুর বিয়োগের মহাকাব্য রচিত হয়েছিল_ অন্তহীন নীল সমুদ্রের বুকে আজ তার চিহ্নটুকুও অবশিষ্ট নেই।
২০১০

ক্লাসঘরের কথা : ২
ড. জেকিল ও মি. হাইড

ড. জেকিল ও মিস্টার হাইড পড়ে আমরা অনায়াসে বুঝতে পারি, বইটিতে 'গুড এন্ড ইভল' এই দুইয়ের একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। মানুষ একদিকে যেমন আশরাফুল মাখলুকাত, তেমনি আবার তার মতো ভয়ংকর জীব পৃথিবীতে নেই। মানুষের মধ্যে যেমন আবির্ভূত হন যীশুখ্রিস্ট তেমনি জন্মগ্রহণ করেন চেঙ্গিস খান বা হিটলার। এতটা বৈপরীত্য অন্য কোনো 'প্রাণীর' মধ্যে নেই। গরুটা 'অশুভ', এ আমরা কখনোই বলতে পারি না। আমার ফুলবাগান খেয়ে ফেললেও না। গরু বা ছাগলের মধ্যে ইভল আছে এ উক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। না খেলে বাঁচে না, তাই এরা খায়। এ তাদের জন্মগত প্রবৃত্তি। কাউকে ধ্বংস করার পৈশাচিক আনন্দে এটা এরা করে না। সাপও কিন্তু ভয় না পেলে, আক্রান্ত না হলে কামড় দেয় না। ইভলের মতো এক-আধটা আচরণ ওদের মধ্যে থাকলেও ঠিক ইভল নেই। এ আছে মানুষের মধ্যে। মানুষের একটা বড় চেষ্টা হচ্ছে অন্যকে গ্রাস করে নিজের স্বার্থ স্ফীত করা, অন্যের মুখ মলিন করা। এই প্রবণতার নামই ইভল, অমঙ্গল। এই ইভলের শক্তি মানুষের মধ্যে এতটাই প্রবল যে কোনো ধর্মই একে পুরো অস্বীকার করতে পারেনি। সব ধর্মকেই, অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও, ইভলকে একটা বড় জায়গা দিতে হয়েছে। অনেক সময় ইভলকে পরাজিত করাকেই বলা হয়েছে ধর্ম। এখন প্রশ্ন: যে ঈশ্বর এত সুন্দর, মহান, অনির্বচনীয় তিনি কেন তার বিরুদ্ধচারী এমন একটি অশুভ সত্তাকে ধর্মে এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিলেন? আমার ধারণা, দিয়েছেন এজন্যই_ এক সময় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে শয়তানকে তাচ্ছিল্য করা অসম্ভব, কেননা সে তাঁর নিজেরই ভেতরের একটি ব্যাপার এবং তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণতার জন্যে সে প্রয়োজনীয়।
* বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে 'জেকিল ও মি. হাইড' বইয়ের ওপর ছাত্রছাত্রীদের আলোচনার শেষে সমাপ্তিমূলক বক্তব্য।
এখন প্রশ্ন: মানুষের মধ্যে এই ইভলটা এলো কোথা থেকে। এটা বের করতে কিন্তু মানবসভ্যতাকে বহু পথ হাঁটতে হয়েছে। প্লেটো এর উৎস বের করতে পারেননি। বলেছেন, ঈশ্বর তো মঙ্গলের প্রতীক। তাই পাপ তো ঈশ্বরের কাছ থেকে আসতে পারে না। যদি ইভলের উৎস আমাদের খুঁজতেই হয় তবে ঈশ্বরের বাইরে অন্য কোনো জায়গায় তার সন্ধান করতে হবে। কিন্তু বিশ্বচরাচরের কোনো কিছুই তো ঈশ্বর-বর্হিভূত নয়। তিনিই তো সবকিছুর ধারক, আধার এবং সৃষ্টিকর্তা। সবই তাঁর দ্বারা আবৃত। সুতরাং অমঙ্গল বলে পৃথিবীতে যদি কিছু থাকেই তবে তার অস্তিত্বও ঈশ্বরের মধ্যেই খুঁজতে হবে। প্লেটো জানতেন না যে এরই মধ্যে ইহুদিদের ধর্মীয় চিন্তা এই প্রশ্নের সমাধান করে ফেলেছে। তারা শনাক্ত করেছে যে শয়তান ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তার থেকে বিচ্ছিন্ন। ব্যাটারটা ইসলাম ধর্মেও আছে। সব সেমিটিক ধর্মেই শয়তান ঈশ্বরের সৃষ্টি। (একজন শিক্ষার্থী: 'হিন্দু ধর্মে ব্যাপারটা কেমন?)' হিন্দু ধর্মে দেবতা আর দানব আলাদা। তাদের দুইয়ের স্রষ্টাই ব্রহ্ম। এই দেবতা আর দানব প্রায় সেমিটিক ধর্মগুলোর ফেরেশতা আর শয়তানের মতোই। কিন্তু দানব শয়তানের মতো ধূর্ত বা কুশলী নয়, সে স্থূল বর্বর ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। সেমিটিক ধর্মগুলোতে শয়তান ঈশ্বরেরই একটি অংশ, যা তাঁর ভেতরকার উচ্চতর মঙ্গলময় সত্তার সঙ্গে অহর্নিশ দ্বন্দ্বমান, যদিও শেষ পর্যন্ত পরাজিত। যা কিছু ভালো তা-ই ঈশ্বর। কিন্তু এই ভালো আবার খারাপেরও আধার। এটা কেমন তার একটা উদাহরণ পরিবেশবাদী হিসেবে দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা সবাই চাই আমাদের দেশ বিত্তশালী হোক, দেশের ধনসম্পদ বাড়ুক, আমাদের সন্তানেরা 'দুধেভাতে' থাকুক। মঙ্গলের জন্যেই এই কামনা। এক কথায় ঈশ্বরের জন্যে। কিন্তু এই ঈশ্বরের মধ্যে যে কিভাবে বিশাল অমঙ্গল লুকিয়ে ছিল তাও আমরা দেখেছি। আমরা লক্ষ করেছি, গত ৩৮ বছরে আমাদের দেশে সম্পদের পরিমাণ বিপুলভাবে বেড়েছে। গত ৩০০০ বছরে এ জাতির পুঞ্জিভূত সম্পদের তুলনায় এর পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু বিত্তের এই বিপুল বিকাশের পেছনে পেছনে এক অশুভ দৈত্য এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের জীবনে। এর নাম পরিবেশ দূষণ। এই বিকাশের ফলে দূষিত হয়েছে আমাদের নদী, বাতাস, মাটি_ এক কথায় আমাদের গোটা জীবন। যেখানে বিত্ত সেখানেই পাপ। যেখানেই ঈশ্বর সেখানেই শয়তান। জীবনের পেছনে মরণ বা আশার পেছনে ভয়ের মতো এই শয়তান সারাক্ষণ আমাদের তাড়া করছে। এক কথায় আমাদের সব ঈশ্বর-আকুতির মধ্যে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে পাপ বা অকল্যাণের অঙ্কুর। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.