নিত্যজাতম্‌-হেরি তব রূপ চিরন্তন by মহসীন হাবিব

তাঁর নাম ছিল স্টিফেন হ্যাচ বার্নওয়েল। জীবনের ৩৩টি বছর তিনি বাংলার প্রশাসনে চাকরি করে গেছেন। ব্রিটিশ প্রশাসনে আইসিএস হিসেবে যোগদান করে পরবর্তীকালে ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) অফিসার হিসেবে তিনি কাটিয়েছেন এই বাংলায়।


দায়িত্ব পালন করেছেন সেটেলমেন্ট অফিসার থেকে শুরু করে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সচিব পদমর্যাদার উচ্চ কর্মকর্তা হিসেবে নিবিড়ভাবে কাছে পেয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক কিংবা সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানকে। বাংলার এই সরকারি কর্মকর্তা ১৯৮৯ সালে ৮০ বছর বয়সে ব্রিটেনে মৃত্যুর আগে তাঁর চাকরি জীবন নিয়ে ইংরেজি ভাষায় অত্যন্ত মজাদার স্মৃতিচারণমূলক একটি পাণ্ডুলিপি রেখে গিয়েছিলেন। বার্নওয়েলের মৃত্যুর ২০ বছর পর তাঁর পুত্র ফিলিপ হ্যাচ বার্নওয়েল সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং তা পুস্তকাকারে ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন ২০১১ সালে। দি লাস্ট গার্ডিয়ান নামক এই বইটিই গত কয়েকদিনে পড়লাম। অসাধারণ এক দায়িত্ব পালন করে গেছেন বার্নওয়েল।
তব অন্তর্ধান পটে হেরি তব রূপ চিরন্তন।
অন্তরে অলক্ষ্যলোকে তোমার পরমাগমন।
লভিলাম চিরস্পর্শমণি:
তোমার শূন্যতা তুমি পরিপূর্ণ করেছ আপনি
জীবন আঁধার হল, সেই ক্ষণে পাইনু সন্ধান
সন্ধ্যার দেউলদীপ অন্তরে রাখিয়া গেছ দান।
বাংলাদেশের দৈন্যদশার মাঝে বার্নওয়েল পড়ে কবিগুরুর এ চরণগুলোই যেন মনের মধ্যে গুনগুন করছে। বার্নওয়েলের এই রচনা সত্যিই বাঙালির ইতিহাসের একটি স্পর্শকাতর সময়ের প্রামাণ্য দলিল। এ যেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলার প্রশাসন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিবিড়ভাবে অবলোকন এবং তাতে অংশগ্রহণের এক বিরল উপাখ্যান। একদিকে তিনি নিজেকে দেখিয়েছেন, অন্যদিকে নিজের দেখাকে দেখিয়েছেন সাবলীল রচনায়। মূলত উপমহাদেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং দ্রুত সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছিল। অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ মানুষটি ভারত উপমহাদেশে চাকরি করতে এসে দেখেছিলেন পরম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি; উত্তরবঙ্গে অবস্থানকালে তিনি এমন সম্প্রীতিও দেখেছেন যে মসজিদের মুতাওয়াল্লী একজন হিন্দু এবং মন্দিরের সেবায়েত একজন মুসলমান, যাঁদের স্থানীয় সমাজই নির্বাচিত করেছে। সেই মানুষটিই দেখেছেন, ১৯৪১ সালের ঢাকার হিন্দ-মুসলমান দাঙ্গা, ১৯৪৬-৪৭ সালের ভয়ানক কলঙ্কজনক দাঙ্গা। '৪১ সালের দাঙ্গার সময় ঢাকায় যিনি এডিএম ছিলেন, তিনি দাঙ্গাকারীদের লক্ষ করে গুলি ছোড়েন। এই এডিএম ভদ্রলোক ছিলেন হিন্দু। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি পক্ষাবলম্বন করেছেন। অচিরে তাঁকে বদলি করে সে স্থানে নিয়ে আসা হয় বার্নওয়েলকে। বার্নওয়েল দাঙ্গা ঠেকাতে নেমে পড়েন। দেখতে পান একটি বাড়িতে লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে দাঙ্গাকারীরা। তিনি তাঁর রিভলবার বের করে দাঙ্গাকারীদের গুলি করার হুমকি দেন। এক পর্যায়ে দাঙ্গাকারীদের বাঁশের লাঠির আঘাতে তাঁর মাথা ফেটে যায় এবং ২৫টি সেলাইর প্রয়োজন হয়।
আরো কত মজার কাহিনী লিখেছেন! তিনি বাকেরগঞ্জের (বর্তমান বরিশাল) ডিএম ছিলেন। লিখেছেন, বাকেরগঞ্জের লোকেরা 'ব্যাড টেমপারড'। সে সময় বাকেরগঞ্জে শত্রুকে হত্যা করার একটি অভিনব পন্থার কথা জেনেছিলেন তিনি। লোকেরা বাঁশের ভেতরের গিঁটগুলোকে ভেতর থেকে পরিষ্কার করে ঠিক পাইপের মতো করে ফেলত। তারপর বিষধর, বিশেষ করে গোখরা সাপ লম্বা করে ঢুকিয়ে পেছনের লেজে তার বা সুতলি দিয়ে টেনে ধরে রাখত। তখন পাকাবাড়ি ছিল খুবই কম। রাতের অন্ধকারে শত্রুর ঘরের বেড়া ফুটো করে সে বাঁশের অগ্রভাগ ঢুকিয়ে দিয়ে পেছনের রশি ঢিল করে দিত। ক্রুদ্ধ সাপ ঘুমন্ত মানুষটিকে মুহূর্তের ভেতর ছোবল দিয়ে লাশে পরিণত করত। নানা বর্ণে বর্ণিত ছিলেন বার্নওয়েল। বহু ভালো মানুষের কথা তিনি লিখেছেন। আবার ধনাঢ্য বা ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকেরা কিভাবে ঘুষ দিতে চেষ্ট করত, তাও লিখেছেন। ব্রিটিশ ভারতের চাকরির আচরণবিধিতে বলা ছিল, শুধু ফুল এবং ফল ছাড়া কোনো উপহার কেউ গ্রহণ করতে পারবে না। তবে বিয়ের মতো অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। তবে সে ক্ষেত্রেও উপহারের ধরন দেখতে হবে। এ কোড অধিকাংশ ব্রিটিশ মেনে চলেছেন।
তবে নির্লিপ্ত এ স্মৃতিচারণায় বাংলার মানুষ, বাংলার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যাপারে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বার্নওয়েল। ইংরেজরা আর যাই হোক, স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে মিথ্যা কথা লেখেন না (যা আমাদের লেখাজোখার জগতে এক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে)। অসংখ্য ইংরেজ এখানে চাকরি করতে এসে ভারতের অভিজ্ঞতা লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। ভারত ছেড়ে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক জন মাস্টার্স ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। বিয়েও করেছিলেন উপমহাদেশে চাকরিকালে এক কলিগের স্ত্রীকে ফুসলিয়ে। সিপাহি বিপ্লব নিয়ে তিনি লিখেছেন নাইটরানার্স অব বেঙ্গল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ নিয়ে লিখেছেন 'ভবানি জংশন'। ব্রিটিশ রাজ নিয়ে লিখেছেন 'রবি ল্যান্সার্স'। এ তিনটি গ্রন্থেই তিনি ভারতীয় জাতিয়তাবাদীদের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। জন মাস্টার্স অসম্ভব ভালোবাসতেন হিমালয় পাহাড়কে। এতটাই যে ১৯৮৩ সালে মৃত্যুর পর তাঁর দেহভস্ম প্লেন থেকে ওই পাহাড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
যা হোক, এখন মূল কথায় আসি। ইংরেজের অত্যাচারের কাহিনী যেমন আছে, তেমনি অসংখ্য ইংরেজের মহানুভবতার কাহিনীও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সত্যি কথায় ভয় করে লাভ নেই, বিশেষ করে কম্পানির কাছ থেকে ব্রিটিশ রাজের হাতে ভারতবর্ষ চলে যাওয়ার পর ইংরেজের যে প্রশাসন এ দেশে ছিল, তা ছিল তুলনাহীন। আর সেই প্রশাসনের সঙ্গে যেসব বাঙালি কাজ করেছেন, তাঁরা ছিলেন মেধাবী এবং চারিত্রিকভাবে সৎ। কথাটি বার্নওয়েলও বারবার জোরের সঙ্গে বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষকে আদর্শিক এবং খুবই আবেগপ্রবণ বলে বর্ণনা করেছেন। দেশভাগের পর সে প্রমাণ রেখেছিলেন সিএসপিরা। তাঁরা মেধা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। ইপিসিএসদের মধ্যেও এসব গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই পিছলে খাদে গিয়ে পড়ছে আমাদের নির্বাহী প্রশাসন ও নির্বাহী কর্মকর্তারা। এর প্রধান দুটি কারণ হলো, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম এবং দিনে দিনে অধিকতর রাজনীতিকরণ। মাত্র কয়েকদিন আগে যখন সরকারের কর্মকর্তাদের কাউকে প্রমোশন দেওয়া হলো এবং কাউকে প্রমোশন বঞ্চিত করা হলো, তখন সচিবালয়ে বঞ্চিতদের মধ্যে কান্নার রোল পড়েছিল। কথা হলো, সরকারই বা কাঁদাবে কেন, আর একজন উপসচিব বা যুগ্মসচিবই বা পদোন্নতি না পেয়ে কাঁদবেন কেন? একজন আসাফউদ্দৌলা, আকবর আলি খান বা সা'দত হোসাইন পদোন্নতি না পেলে কি হাউমাউ করে কাঁদতেন? যে সরকার আসে তারা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গায়ে দলের সিল লাগানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সরকারি কর্মকর্তারাও বা এত সহজে গায়ে সিল লাগতে দেন কেন? আমরা সুস্পষ্টভাবে জানি, মেধা নয়, প্রশিক্ষণ নয়_শুধু দলীয় পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা দিনে দিনে অধিকতর উচ্চপদে উঠে যাচ্ছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, শুধু সচিবালয় নয়, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি অধিদপ্তর, পরিদপ্তরে ৯০ শতাংশ কর্তকর্তা-কর্মচারী এখন দলীয় পরিচয় বহন করে! এমনকি সরকারি তো বটেই, বেসরকারি ব্যাংক, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন দলীয় পরিচয় দরকার হয়! তাই বড় ভয় হয়, আগামী দিনে কতটা নির্ভরযোগ্য থাকবে বাংলাদেশের এই প্রশাসন? এই কী সেই গৌরবোজ্জ্বল প্রশাসনের উত্তরাধিকার? কোথায় পাব আইসিএস, সিএসপি কর্মকর্তাদের সেই ক্ষমতা, সেই মানবিক গুণাবলি?
পুনশ্চ : মাঝেমধ্যেই আজিজ সুপার মার্কেটে দেখি আকবর আলি খান বইয়ের দোকানে। গত শনিবারও দেখেছি তিনি একটি দোকানে নিবিড়ভাবে বই তল্লাশি করছেন। খুবই আশঙ্কা হয়, আগামী দিনে কোনো অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ কর্মকর্তাকে এমনভাবে বই ঘাঁটতে দেখা যাবে কি না! বরং হয়তো অবসর জীবনে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণে তাঁদের সময় কাটবে বলে অনুমান হয়।
লেখক : সাংবাদিক, mohshin.habib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.