চারদিক-ঙিন সুতোয় বোনা স্বপ্ন by শারমিন নাহার

সূর্যটা সবে পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়েছে। সারা দিন ছড়িয়ে দেওয়া তীর্যক আলো ও তেজ কমে আসতে শুরু করেছে। স্তিমিত হওয়া সূর্যের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমের আকাশ থেকে পুরো আকাশে। এমন সময়ে মিরপুর ১০ নম্বরের প্যারিস রোড দিয়ে চলতে খারাপ লাগছে না। রিকশায় বৈকালিক ভ্রমণ কিন্তু মন্দ নয়।


ঘুরতে ঘুরতে কাজের সুবাদেই প্যারিস রোডে ঢুকে খুঁজতে থাকি তাঁতির বাড়ি। তবে খুঁজে পেতে খুব বেশি সময় লাগল না। মূল প্যারিস রোড পেরোলেই বিহারি ক্যাম্পের সংকীর্ণ গলি আর ঘুপচির মাঝেই তাঁতকলের ঘটাং ঘটাং শব্দ কানে এসে লাগল। উঁকি দিয়ে প্রত্যাশিত জায়গাটা পেয়ে যাই। ছোট মাটির ঘরের ভেতরে টাঙানো আছে পাঁচটা মেশিন। বাইরের আলো তখনো মিলিয়ে যায়নি। তবে ঘরে ঢুকে মনে হলো যেন সন্ধ্যা নেমেছে, তাই আলো কিছুটা কম। জ্বলছে ৬০ ওয়াটের একটা বাতি। আর এই স্বল্প আলোতে কাজ করতে বেশ কষ্টই হচ্ছে তাঁতিদের। পাঁচটা মেশিন পাতা থাকলেও তাতে কাজ করছেন মাত্র দুজন। তাঁদের মধ্যে একজন মোহাম্মাদ ইসরাইল, অন্যজন মোহাম্মাদ শামীম। ইসরাইল এক রঙের সুতার সঙ্গে অন্য রঙের সুতা মিলিয়ে দিচ্ছেন। আর মিলিয়ে দেওয়া সুতা দিয়ে মোহাম্মাদ শামীম তাঁতকলে কাপড় বুনছেন। সামনে ঈদ, তাই দম ফেলার ফুরসত তাঁদের নেই। কথা বলবেন কীভাবে! তবে সৌজন্য রক্ষার জন্য আমাদের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মাদ শামীম।
কত দিন ধরে কাজ করছেন?
মেশিনের সুতার ফাদ্দির ফাঁকে নিজের মুখ অনেকটা ঢেকেই গেছে। সুতার আড়াল থেকে মুখ তুলে বলেন, ‘তা ১০ বছর হইল প্রায়। সক্কাল বেলা নয়টা বাজে আসি, আর রাত ১২টা বাজে বাড়ি যাই।’
এত সময় কাজ করেন?
‘আসলে কাম টানা করি না। কামের ফাঁকে উইঠা হাঁটাহাঁটি করি। টানা এত টাইম বইসা থাইকা কাম করন যায় না। আর বারেবারে কারেন্ট যায়, কারেন্ট গেলে তো মনে করেন কাম করা যায় না।’
তার মানে, বিদ্যু ৎ চলে গেলেই শান্তি! কাজ করতে হয় না?
‘না, তা না। কাম না করলে মজুরি পামু না। আর আমাগো তো দিন হিসাব কইরা কাম না। শাড়িপ্রতি হিসাব হয়। সামনে ঈদ, তাই কাম বেশি। মহাজনে কইছে, বেশি টাইম যেন নষ্ট না করি।’
কথা বলতে বলতে মাকুতে কিছুটা শাণ দিয়ে নেন তিনি। একটা শাড়ি বুনতে কত দিন লাগে?
‘তা সাত দিন লাগে। ঈদের আগে কামের চাপ বেশি। তয় আমরা তো মেশিন না যে বেশি কাম করতে পারুম। তাই ফাঁকি দেই না।’
একটা শাড়ি বুনলে কত টাকা দেয়?
এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যান মোহাম্মাদ শামীম। বলেন, ‘দেয় শাড়িপ্রতি হাজার ট্যাকা। মাসে চারটা শাড়ি বুনি, আর সব মিলাই পাই চার হাজার ট্যাকা। এতে আসলেই সংসার চলে না, তয় অন্য কিছু করনের নাই, তাই এই কামই করি।’
আর ঈদের আগের বোনাস?
এবার হাসেন তিনি। উত্তর দিলেন না, তবে হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে উত্তর। যেখানে মজুরিই বাড়ে না, সেখানে ঈদের আগে বোনাস পাওয়ার প্রশ্ন কেবলই প্রহসন। ঈদের বাজারে বেনারসি শাড়ি দেদারছে বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে, অথচ যাঁরা শাড়ি বুনছেন, তাঁদের মজুরির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আজও জরাজীর্ণ তাঁতকলের মতোই আস্তাকুঁড়ে পড়ে আছেন তাঁতিরা।
বাড়িতে কে কে আছে?
কিছুটা লাজুক হাসি হেসে বলেন, ‘আমি আর আমার বউ চান্দা।’
ঈদের আগে বউকে কী কিনে দিলেন?
‘কী আর দিমু! তয় স্বপ্ন দেখি, একদিন একটা কেন, দশটা বেনারসি কিনা দিমু আমার চান্দারে। প্রতিটা শাড়ি বুনি আর ভাবি, আমার চান্দারে এই শাড়ি পিনলে না জানি কেমন দেহাইবে।’
রঙিন সুতার পরত দিয়ে আবার মেশিন টানেন। সুতার সঙ্গে রঙিন সুতা মিলে তৈরি হয় নতুন বেনারসি শাড়ি। তবে যাঁরা এই শাড়ির কারিগর, তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। সুতার সঙ্গে অন্য সুতা মিলে কাপড়ের রং বদল হয়। কিন্তু এই জীবনের নানা রং তাঁদের ছুঁয়ে যায় না। তার পরও তাঁরা প্রিয়জনকে খুশি করার স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
শারমিন নাহার

No comments

Powered by Blogger.