জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ... by অজয় দাশগুপ্ত

বছরতিনেক আগে সুন্দরবনের করমজল নামক স্থানে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখার সুযোগ হয় বাংলাদেশে সরকারিভাবে গড়ে ওঠা একমাত্র বন্য প্রাণী (কুমির) প্রজনন কেন্দ্রটি। একটি জলাশয়ে দুটি বড় কুমির ছিল মাথা তুলে। আমাদের সঙ্গী ছিলেন ডেপুটি ফরেস্ট রেঞ্জার আবদুর রব। কুমির সম্পর্কে তার ভাণ্ডারে তথ্যের যেন শেষ নেই।


তিনি একটি কুমিরের নাম ধরে ডাক দিলেন। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি তার ডাকে সাড়া দিয়ে একটি কুমির জলের ওপরে কয়েক হাত লাফ দিয়ে এগিয়ে এলো। যত দূর মনে আছে, তিনি ডেকেছিলেন 'জুলিয়েট' নাম ধরে। বুধবার সমকালে দেখলাম এই জুলিয়েটই ২৯টি বাচ্চা দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি মারা গেছে, ২৭টি বেঁচে আছে। তাদের রাখা হয়েছে ইনসেনটিভ কেয়ারে। পরে কেন্দ্রের প্যানে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে। করমজলে বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে এবার নিয়ে সপ্তমবার মতো কুমিরের বাচ্চা ফুটানো হলো। এ কেন্দ্রে এখন নতুন ২৭টিসহ শতাধিক নোনা পানির কুমিরের বাচ্চা লালন-পালন করা হচ্ছে।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী স্টেশনের অধীন করমজল ফরেস্ট ক্যাম্পে এ কুমির প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় ২০০২ সালে। পরিবেশ বিশেষ করে সুন্দরবনের প্রাণিকুলের ভারসাম্য বজায় রাখতে বিলুপ্তপ্রায় নোনা পানির কুমিরের বংশ বিস্তারের জন্য সরকার এ প্রকল্প হাতে নেয়। সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর বয়স হলে কুমিরকে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে ছাড়া হয়। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে থাকা পিলপিল ও টুকটুকি নামের আরও এক জোড়া প্রাপ্ত বয়স্ক কুমির রয়েছে। এদের মধ্যে পিলপিল সম্প্রতি ৪০টি ডিম দিয়েছে। এসব ডিম থেকে আরও বাচ্চা মিলবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে কুমির চাষ জনপ্রিয় হয়েছে। উদ্যোক্তারা মনে করেন, কুমির খুব লাভজনক রফতানি পণ্য। ময়মনসিংহের একটি প্রকল্পে ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। সে তুলনায় করমজলের প্রকল্পটি যেন সতিনপুত্র। সরকার থেকে সামান্য অর্থই প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়। সেখানের কর্মীদের জীবন কাটাতে হয় কঠিন পরিবেশে। চারপাশে অগাধ জলরাশি। কিন্তু সে পানি নোনা এবং মুখে দেওয়া যায় না। বাইরে থেকে খাবার পানিসহ বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ নিতে হয়। যেহেতু প্রকল্পের জন্য সরকারের বরাদ্দ কম, তাই মানুষ এবং কুমির উভয়কেই হতে হয় কষ্টসহিষ্ণু।
করমজল সফরকালে মনে হয়েছিল, কয়েকটি চৌবাচ্চায় রাখা কুমিরের ছানাগুলোর জন্য নিরাপত্তার আয়োজন যথেষ্ট নয়। বনের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় কোনো দেয়াল তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু পর্যাপ্তসংখ্যক প্রহরীরও ব্যবস্থা নেই। পরে শুনেছি, বেশ কয়েকটি কুমিরছানা চুরি হয়ে গেছে। এগুলো ব্যাংককে কতবার দেখিয়ে কে কত ঋণ নিয়েছে কে জানে!
আবদুর রব সে সময়ে জানিয়েছিলেন, কুুমিরের হাত-পায়ের নখ থেকে সবকিছু মূল্যবান। তার হিসেবে সুন্দরবনের নদী-খালে পাঁচ হাজারের বেশি কুমির পালন করা যায়। বড় হলে সেগুলো হয়ে উঠবে আকর্ষণীয় রফতানি পণ্য। একই সঙ্গে তারা কিন্তু বনের বাঘের সঙ্গে একযোগে 'বনে বাঘ ডাঙায়
কুমির' প্রবাদের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারে!
 

No comments

Powered by Blogger.