নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস-এ দেশে নিরন্তর নারীর লড়াই by জোবাইদা নাসরীন

১৯ আগস্ট মাদারীপুর সদর উপজেলায় গ্রাম্য সালিসে অপমানিত হয়ে ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহত্যা করেছে শিরিন আক্তার। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, ছাগলে গাছের পাতা খাওয়ায় প্রতিবেশী শাহ আলম যখন ছাগলটির মালিক শিরিনকে ধরে মারছিল, তখন প্রতিবাদী শিরিন তার মুঠোফোনটি শাহ আলমের দিকে ছুড়ে মারে।


কিন্তু শিরিনের এই প্রতিবাদ সহ্য করতে পারেনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে পাঠ করা হয়। সালিসে শাস্তিস্বরূপ শিরিনকে শাহ আলমের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। সেখানেও প্রতিবাদ করে শিরিন বলেছিল, ‘যে আমাকে মারধর করেছিল, তার কাছেই কেন আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে?’ কিন্তু এই সমাজ পুরুষের সমাজ; সেখানে নারীর ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন। সর্বশেষ, মেয়েটি আত্মহত্যা করে।
শিরিনের এই পরিণতি এ দেশে পুরুষতান্ত্রিক অহংয়ের বিরুদ্ধে নারীর নিরন্তর লড়াকু যাত্রাপথের এক বাস্তব চিত্র। সে শাহ আলমকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সালিসের বিচারের প্রতি প্রশ্ন ছুড়েছে। এ দেশে শিরিনের মতো মেয়ে আছে অনেক, যারা প্রতিনিয়তই তার নিজস্ব অবস্থান থেকে, তার মতো করেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর অবস্থান জারি রাখে। বাংলাদেশে আজও বেশির ভাগ সালিসই নারীর বিপক্ষে যায়। এর আগে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় সালিসে অপমান ও সমাজচ্যুত করার পর ১৫ আগস্ট চার সন্তান নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ফেরদৌসী বেগম। সর্বশেষ, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় গরম পানি ঢেলে ঝলসে দেওয়া হয়েছে নারীর শরীর (প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট ২০১১)। এর বাইরেও যে অনেক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় কিংবা অন্যান্য গণমাধ্যমে আসে না, সে সম্পর্কে মানুষ জানতেও পারে না।
আজ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। প্রতিরোধের স্মরণ মানে, প্রতিরোধে শামিল হওয়া এবং আগামী দিনের প্রতিরোধের প্রস্তুতি। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী রাত্রিকালীন কোচ থেকে নেমেছিল কিশোরী ইয়াসমীন। অভাবের সংসারে শুধু নিজের অন্ন জোগাতে ঢাকায় কাজ করতে এসেছিল ১২ বছরের কিশোরী ইয়াসমীন। চতুর্থ শ্রেণী পাস করা ইয়াসমীনের স্বপ্ন ছিল, ঢাকায় গিয়ে কাজ করে টাকা জমাবে। আর সেই টাকাতেই চালু হবে তার পড়াশোনার চাকা। এই ঢাকা শহরেই গৃহশ্রমিকের কাজ করত সে। তিন বছর ধরে বাড়ি যেতে পারেনি। তাই সেদিন রাতের গাড়ি ধরেই যেতে চেয়েছিল বাড়ি। বাসটি তাকে তার বাড়ির কাছের একটি জায়গায় নামিয়ে দেয়। জায়গাটি ছিল দিনাজপুরের দশমাইল মোড়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই জায়গায় আসে টহল পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান। তারা মেয়েটিকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পিকআপে তুলে নেয়। এর পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। পরের দিন সকালেই ইয়াসমীনের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ শেষে দিনাজপুরে খুন হয়েছিল কিশোরী ইয়াসমীন। পুলিশ ঘটনার কথা অস্বীকার করে। কিন্তু প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষ। ইয়াসমীনের মৃত্যু সে সময়ে ঢাকা-দিনাজপুরের দূরত্ব মুছে দিয়ে সবাইকে সমভাবে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালায়। মারা যান সামু, কাদের, সিরাজসহ নাম না-জানা আরও সাতজন ব্যক্তি। ইয়াসমীন ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত আসামি এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজনের ফাঁসির রায় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যকর করা হয়। যদিও এখন পর্যন্ত এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে সাতজনকে পুলিশ হত্যা করেছিল, সে ঘটনার বিচার হয়নি। সেদিন থেকে সেই ইয়াসমীন বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের প্রতিরোধের স্মারক হয়ে আছে।
এই ১৬ বছরে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের চিত্র কি পাল্টেছে? না। যেখানে ইয়াসমীনের ঘটনার এত বছর পরও এ দেশে স্বামীর নির্যাতনে চোখ হারাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে; রাতের অন্ধকারে উলঙ্গ করে, ধর্ষণ করে, হত্যা করে, তারপর গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় আদিবাসী নারীর লাশ; যৌতুকের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি মাসেই নিগৃহীত হয় অসংখ্য নারী; শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লড়তে হয় যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার জন্য—সেখানে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র কতখানি সোচ্চার, তা সাদা চোখেই বোঝা যায়। আজও সালিসে নারীর বিপক্ষে রায় যায়—সেই নারী একঘরে কিংবা সমাজচ্যুত হয়। রাষ্ট্রীয় কৌশলের বদৌলতে আবার জীবন ফিরে পায় ফতোয়া। আর এর তাপে জ্বলে নারীর জীবন।
কখনো তারা প্রতিবাদের উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়; কখনো লড়াই করতে করতে মরে। এভাবে প্রতিবছরই জীবন দেয় কোনো-না-কোনো ইয়াসমীন, শিরিন আক্তার। নামের তালিকা দীর্ঘ হয় মাত্র। নতুন নতুন ঘটনায় আমরা আরও হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। তবু আমাদের সাহসের মশালটিও যেন জ্বলছে আমাদের স্বপ্নের সঙ্গে—ইয়াসমীন, শিরিনের সঙ্গে। ইয়াসমীন, শিরিন কিংবা ভিকারুননিসার সেই ছোট্ট মেয়েটি বারবার কাছে এসে যেন বলে যায়, এ লড়াই প্রত্যেক নারীর লড়াই, এ লড়াই আমাদের বাঁচার লড়াই—এ লড়াইয়ে জিততেই হবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.