শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-একজন আনছার আলীর ভিন্ন চিন্তা by মিলন রহমান

প্রতিবেশীরা নানা জাতের দেশি সবজি চাষ করেন। তিনিও সামান্য জমিতে ফুলকপি ও টমেটো চাষ করতেন। কিন্তু সংসারের অভাব যেন দূর হচ্ছিল না। একপর্যায়ে চাষ করলেন মিষ্টি মরিচ। প্রথমবার চাষের খরচই তুলতে পারেননি। এলাকার লোক-জন খেয়েই সব শেষ করে ফেলে!


পরেরবার আবারও মিষ্টি মরিচ চাষ করতে গেলে গ্রামের লোকজন হাসাহাসি শুরু করেন। এমনকি নিজের বউও রাগারাগি করেন। ঝগড়া হয়। বউ রাগ করে ভাতও খেতে দেননি। কিন্তু যখন এ মরিচ চাষ করে সাফল্য পেলেন, তখন সবাই প্রশংসা শুরু করেন। খুশি হন বউও।
গল্পের শুরুটা ১২ বছর আগের। নায়ক বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দাড়িদহ ইউনিয়নের বুজরুক শোকরা গ্রামের আনছার আলী। তাঁর সেই সময় আর এই সময়ের পার্থক্য অনেক। অভাবী মানুষটি আজ সফল চাষি। মিষ্টি মরিচ দিয়ে শুরুর পর বিদেশি সবজি চাষ করে অভাব জয় করেছেন। তাঁর কাছে পরামর্শ নিয়ে সেখানকার অনেকেই বিদেশি সবজি চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
আনছারের গ্রামে এক দিন: উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে দাড়িদহ ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের একটি গ্রাম বুজরুক শোকরা। এ গ্রামেরই বাসিন্দা আনছার (৬০)। সম্প্রতি তাঁর সাফল্যের গল্প শুনতে বুজরুক শোকরা গ্রামে যাওয়া। গ্রামে গিয়ে জানা গেল, তিনি সবজিখেতে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত তিনি। পরিচয় পেয়ে খেত থেকে উঠে এসে শোনালেন নিজের সাফল্যের গল্প।
যেভাবে শুরু: বাবার কাছ থেকে দুই বিঘা জমি পেয়েছিলেন আনছার। সেই জমি নিয়ে ভাইদের সঙ্গে মামলা হয়। একপর্যায়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন। নিঃস্ব হয়ে যান আনছার। তবে দমে যাননি। অন্যের জমি বন্ধক নিয়ে ফুলকপি ও টমেটো চাষ শুরু করেন। এসব সবজির বীজ কিনতে এক দিন বগুড়া শহরে যান। সেখানে একজন বীজবিক্রেতা তাঁকে মিষ্টি মরিচ চাষের পরামর্শ দেন। ২০০০ সালের দিকে মিষ্টি মরিচ চাষ শুরু করেন। এ মরিচকে ক্যাপসিকাম বলা হয়।
আনছার জানান, চায়নিজ রেস্টুরেন্টসহ বড় বড় হোটেলে এ মরিচের চাহিদা প্রচুর। প্রথমবার মরিচ চাষ করে কিছু পাওয়া না গেলেও দ্বিতীয় বছর থেকে টাকা আসতে শুরু করে। বগুড়া শহরে সেই মরিচ বিক্রি করতেন। প্রথমে প্রতিটি মরিচ পাঁচ টাকা করে বিক্রি হয়।
এ মরিচ বিক্রির এক ঘটনা আনছারের সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। সেই গল্পও শোনালেন আনছার।
একদিন বগুড়া শহরে মরিচ বিক্রি করছেন। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা এসে তাঁর সব মরিচ কিনে নিয়ে যান। পরে আরও দুই থেকে তিন দিন একইভাবে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা সব মরিচ কিনে নিয়ে যান। আনছার খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ওই ব্যাংক কর্মকর্তা এসব মরিচ বেশি দামে ঢাকায় বিক্রি করেন। ঢাকায় কোথায় এসব মরিচ বিক্রি হয়, তা জানার চেষ্টা করলেও ওই কর্মকর্তা ঠিকানা দেননি আনছারকে। অনেক চেষ্টার পর তিনি জানতে পারেন, ঢাকার চায়নিজ রেস্তোরাঁয় এসব মরিচ বিক্রি হয়।
এবার আনছার আলী নিজেই ঢাকায় গিয়ে কয়েকটি রেস্তোরাঁর সঙ্গে কথা বলে আসেন। কয়েকটি রেস্তোরাঁ আনছারের কাছ থেকে সরাসরি মরিচ কিনতে রাজি হয়। এভাবেই ঢাকায় মরিচ বিক্রি শুরু হলো তাঁর।
ওইবার সাত শতক জমিতে মিষ্টি মরিচ চাষ করে ২০ হাজার টাকা লাভ করেন তিনি। পরেরবার আরও বেশি জমিতে চাষ করেন। মিষ্টি মরিচ চাষি হিসেবে তাঁর নাম ঢাকার অভিজাত রেস্তোরাঁগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি লাভের টাকায় জমি কেনেন। বাড়তে থাকে মিষ্টি মরিচ চাষের জমিও।
বিদেশি সবজি চাষ: ঢাকায় মিষ্টি মরিচ বিক্রি করতে গিয়ে রেস্তোরাঁর লোকজনের কাছ থেকে বিদেশি সবজির কথা জানতে পারেন আনছার। তিনি তখন বিদেশি সবজির বীজ খুঁজতে শুরু করলেন। পেয়েও গেলেন। শুরু করলেন বিদেশি সবজির চাষ।
এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জাতের বিদেশি সবজির চাষ করেছেন আনছার। কথা বলতে বলতে ঘুরে দেখালেন তাঁর সবজির বাগান। বোঝালেন, কোন সবজি কীভাবে খাওয়া হয়। ২০০০ সালে অ্যাসপারাগাস গাছ লাগান আনছার। এটি সাধারণত স্যুপের সঙ্গে খাওয়া হয়ে থাকে। ২০ শতক জমিতে একবারই অ্যাসপারাগাস লাগিয়েছেন। এ সবজি প্রতি কেজি ২০০ টাকা করে বিক্রি হয়।
থাইল্যান্ড থেকে বীজ এনে চাষ করেছেন সুইটকর্ন, যা মিষ্টি ভুট্টা নামে পরিচিত। এটি কাঁচা বা সেদ্ধ করে খাওয়া যায়। এ ভুট্টা পাঁচ বিঘা জমিতে চাষ করছেন। ব্রকলি নামের একটি সবজি চাষ করেছেন আনছার। এটি ভাজি ও ঝোল করে খাওয়া হয়। গত বছর তিনি দুই বিঘা জমিতে এ সবজি চাষ করেন।
আনছারের চাষের তালিকায় রয়েছে চেরি টমেটো, লেটুস, থাই আদা, শিমলা মরিচ, থাইপাতা, স্কোয়াশসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি।
‘বিদেশি সবজি সহজে কেউ চাষ করে না। ধান চাষ করে যে লাভ হয়, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লাভ হয় বিদেশি সবজি চাষে। তাই এর দিকে ঝুঁকে পড়া।’ বলেন আনছার।
নিজের গড়া খামার: এখন বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন বিদেশি সবজি, বীজ ও চারা কিনতে আনছার আলীর গ্রামে আসেন। তাই তিনি ‘ওয়েস্টার্ন ভেজিটেবল প্রডাকশন কৃষি ফার্ম’ নামের একটি খামার গড়ে তুলেছেন। এখন সবজি কেনার জন্য ঢাকা থেকে এ ঠিকানায় অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী সবজি কখনো নিজেই পৌঁছে দেন, কখনো ঢাকাগামী পরিবহনে তুলে দেন।
সফল মানুষ: বিদেশি সবজি চাষ করে পাওয়া টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন আনছার। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এ পর্যন্ত ১৩ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। কুঁড়েঘর থেকে হয়েছে পাকা বাড়ি।
তবে একা উন্নতিতে বিশ্বাসী নন সফল এ মানুষটি। তিনি চান তাঁর মতো আরও আনছার তৈরি হোক।
বিদেশি সবজি চাষে উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে চান আনছার। এরপর সেই শিক্ষণ ছড়িয়ে দিতে চান গ্রামের কৃষকদের মধ্যে।
আনছার জানান, এরই মধ্যে তাঁর কাছে পরামর্শ নিয়ে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পশ্চিম পাড়ার সোনা মিয়া ও বাবু মিয়া, শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলার টেপাগাড়ি গ্রামের মিজানুর রহমান, ঢাকার সাভারের মিশরকোলা গ্রামের সিদ্দিকুর রহমান ও রবিউল হোসেন বিদেশি সবজি চাষ করছেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন।
আনছার তাঁর স্ত্রী ও ছেলের বউকে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এবার প্রায় ১৩ বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছেন আনছার।
শীতকালীন সবজি হিমাগারে রেখে অন্য মৌসুমে বিক্রি করতে পারলে বেশি লাভ। তাই আনছারের দাবি, এসব সবজি বাজারজাত করার জন্য সরকারিভাবে হিমাগার তৈরি করতে হবে।
কৃষি বিভাগের কথা: শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আনছার আলী একজন আদর্শ কৃষক। কৃষি বিভাগ তাঁকে সব সময় পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করে।’
স্বীকৃতি: আর্থিকভাবে তো লাভবান হয়েছেনই, সঙ্গে এ কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন আনছার। গত বছর ‘সিটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা’ পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন সময় বিদেশিরা তাঁর বাড়িতে সবজির চাষ দেখতে আসেন।

No comments

Powered by Blogger.