গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য ছিল অভিন্ন by ড. মুহাম্মদ আশকার ইবনে শাইখ

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার এক জনাকীর্ণ স্থানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জনসভায় যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, সেটি যে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নীলনকশা ছিল তা পরিষ্কার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে অপশক্তি যে উল্টোপথে দেশ-জাতিকে ঠেলে দিয়েছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনা এরই ধারাবাহিক অপক্রিয়া।


অবশ্য এর আগেও এমন প্রচেষ্টা ওরা চালিয়েছিল কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে বোমা পুঁতে রেখে। তবে ২১ আগস্টের পৈশাচিকতার লক্ষ্য ছিল জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নকারী শেখ হাসিনাসহ অন্যদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এবং এর পেছনে যে তৎকালীন ক্ষমতাসংশ্লিষ্টদের গভীর যোগসাজশ ছিল এও এখন পরিষ্কার। ওই ঘটনায় আইভি রহমানসহ প্রাণ হারান অনেকে। শেখ হাসিনাসহ অনেকেই প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁরা সবাই সেই দুঃসহ স্মৃতি ও ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। যে দেশে রাষ্ট্রের পরিচালকরা এমন বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় জোগান, খুনিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দেন (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বঘোষিত খুনিদের তো তাই করা হয়েছিল), পুরস্কৃত করেন, খুনের বিচারের পথ আইন করে রুদ্ধ করে রাখেন, তাদের সভ্যতা-মানবতার কলঙ্ক বললে অত্যুক্তি হয় না।
২১ আগস্টের নৃশংস ঘটনার পর তৎকালীন সরকার কত নাটক করল, পুরো পুরিস্থিতি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কত রকম অপচেষ্টা চালাল এবং প্রমাণ করল এই 'সব সম্ভবের দেশ'-এ মানবতা শব্দটি বড় বেশি অপাঙ্ক্তেয়। তাঁরা যখন আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বড় বড় কথা বলেন, তখন সত্যি মনে হয় কী বিচিত্র এ দেশের রাজনীতি! ২১ আগস্টের বর্বরোচিত ঘটনার সম্পূরক চার্জশিট ইতিমধ্যে দাখিল করা হয়েছে এবং এর বিচারপ্রক্রিয়া চলমান। কাজেই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। তা ছাড়া ওই নৃশংসতার উপাখ্যান শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গন, বিশেষ করে সচেতন মহলের জানা আছে। তাই বেশি কিছু বলা হবে চর্বিত চর্বণ মাত্র। আমি শুধু এ প্রসঙ্গেই ভিন্ন আঙ্গিকে খুব সংক্ষেপে কিছু কথা লিখতে চাই।
৫ জুলাই, ২০১১ '১৪ আগস্ট হাওয়া ভবনে হাসিনা হত্যার ছক তৈরি হয়' শিরোনামে জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যেসব তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত হয়েছে, তা শিউরে ওঠার মতো। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজি প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সূত্র ধরে প্রতিবেদনটিতে সবিস্তারে সব তুলে ধরা হয়েছে। ওই জবানবন্দির একটি তথ্যচিত্রও ধারণ করা হয়েছে, তা প্রতিবেদন পাঠেই জানলাম। অধিকতর তদন্তের পর সম্পূরক চার্জশিটে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের অনেকেই তৎকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরাও রয়েছেন। এই স্ববিরোধীরা একসময় আমাদের 'ভাগ্য নিয়ন্ত্রক' ছিলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করে দেশ-জাতির তথাকথিত কল্যাণের বুলি আওড়িয়েছেন_তা ভাবতে শুধু বিস্ময়ই লাগে না, রীতিমতো শঙ্কার সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, কোন দুঃসময় দেশ-জাতি অতিক্রম করে এসেছে! রাজনীতিতে মতবিরোধ থাকবে এবং এটিই স্বাভাবিক, কিন্তু স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত বাংলাদেশে রাজনীতির নামে গত সাড়ে তিন দশকে একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মারা এবং তাদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত কতিপয় দেশপ্রেমিক (?) রাজনীতিক রাজনীতির যে সর্বনাশ ঘটিয়েছেন, এর নাগপাশ থেকে এ জাতি কবে মুক্ত হতে পারবে জানি না।
১০ আগস্ট লন্ডনের একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে ২১ আগস্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল। একজন তরুণ যার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে এবং তা-ও আবার এই লন্ডনে, সে খুব ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন করল_আমাদের অগ্রজরা আজকের যে বাংলাদেশ এর জন্যই কী যুদ্ধ করে বিশ্বমানচিত্রে দেশের অবস্থান নির্ণয় করেছিলেন?
ওই তরুণ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে প্রায় সাত-আট মাস বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল এবং মাঝেমধ্যে সে দেশে যায়। দেশের রাজনীতি ও স্ববিরোধী রাজনীতিকদের সম্পর্কে তার যে মূল্যায়ন, তা মোটেও ভুল নয় এবং বর্তমান প্রজন্মের সিংহভাগ এসব ব্যাপারে খুব সচেতন। আমাদের আশা ও শক্তির ভিতটা এখানেই খুব মজবুত। এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার নানা রকম অপচেষ্টা সত্ত্বেও তারা বিভ্রান্ত হয়নি। ২১ আগস্ট সম্পর্কেও প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা কম হয়নি। নিশ্চয়ই আশা করব_স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে ২১ আগস্টের হোতাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হবে এবং তাদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে এ দেশ-জাতির আগামীর নিরাপদ অগ্রযাত্রার পথ নিশ্চিত করা হবে। খুলে যাবে অনেকের মুখোশও। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থেই এর দ্রুত বিচার হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : লন্ডন প্রবাসী গবেষক

No comments

Powered by Blogger.