চরাচর-একটি ভাষা শিক্ষা গ্রন্থের কথা by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের প্রীতি যদি সারা বছর অক্ষুণ্ন থাকত, তাহলে আমাদের চিত্র আরো উজ্জ্বল হতো। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য রক্তস্নাত আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারিভাবে আজও বাংলা ভাষা ইংরেজি ভাষার গুরুত্বকে ম্লান করে দিয়ে জাতে উঠতে পারেনি। বাংলা ভাষা তার আপন গৌরবগাথা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি বহু দূর।

মাতৃভাষার প্রতি আমাদের অবহেলা ও ঔদাসীন্য প্রতিদিন একটু একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন প্রভৃতি গণমাধ্যমেও প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষাকে আধুনিকভাবে প্রকাশের নামে চরমভাবে বিকৃত করা হচ্ছে। কবি শামসুর রাহমান তাই তাঁর কবিতায় বলে গেছেন- 'বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা'। আধুনিক পৃথিবীতে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হলে মাতৃভাষার পাশাপাশি বিদেশি ভাষাও শিখতে হবে, তাই বলে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- 'আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।' শ্রদ্ধার সঙ্গে শুদ্ধভাবে রক্তে অর্জিত এই মাতৃভাষা বাংলাকে চর্চা করে যেতে হবে। দেশের বরেণ্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক হায়াৎ মামুদ ২০০৭ সালে রচনা করেছেন 'বাংলা লেখার নিয়মকানুন' গ্রন্থটি। এটি আমাদের ভাষাচৈতন্যের গভীরতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে অনেক গুণ। বিশেষ করে আমরা যারা গণমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং যারা নিজেকে 'মাতৃভাষাপ্রেমী' হিসেবে দাবি করি, তাদের জন্য এই বইটি গুরুত্ব বহন করে অনেকখানি। প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার ১৯৬ পাতার এই গ্রন্থের প্রতিটি পর্বই বর্ণনা করা রয়েছে স্বতন্ত্র এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে। হায়াৎ মামুদ এই বইয়ে বলেছেন- 'মাতৃভাষাও শুদ্ধভাবে বলতে, পড়তে, লিখতে হলে নিয়মনিষ্ঠভাবে তার চর্চা না করে উপায় নেই। আমাদের দৃষ্টি সাধারণ মানুষের দিকে এবং আমাদের উদ্দেশ্য নিতান্তই সামান্য : মাতৃভাষা বাংলা যতটুকুই লিখুন, শুদ্ধ ও নির্ভুল লিখুন, ব্যাকরণসম্মতভাবে লিখুন।' 'বাংলা লেখার নিয়মকানুন' গ্রন্থটি থেকে প্রায়ই ভুল হয়ে থাকে এমন কিছু শুদ্ধ বানান (প্রথমে 'অশুদ্ধ', পরে 'শুদ্ধ') তুলে ধরা হলো- অংশীদারিত্ব হবে অংশীদারত্ব, অংক হবে অঙ্ক, অত্যাধিক হবে অত্যধিক, অদ্ভূত/অদ্ভুদ হবে অদ্ভুত, অপরাহ্ন হবে অপরাহ্ন, আইনতঃ হবে আইনত, আকূল হবে আকুল, আবিস্কার হবে আবিষ্কার, ইতিমধ্যে হবে ইতোমধ্যে, উচিৎ হবে উচিত, উদ্দ্যোগ হবে উদ্যোগ, উপলক্ষ্য হবে উপলক্ষ, উল্লেখিত হবে উলি্লখিত, এতো হবে এত, কতো হবে কত, কৃতীত্ব হবে কৃতিত্ব, খুনি হবে খুনী, গরীব হবে গরিব, চিত্রাংকন হবে চিত্রাঙ্কন, ছিলো হবে ছিল, জরুরী হবে জরুরি, দুটি হবে দু'টি, দেশি হবে দেশী, দেশাত্ববোধ হবে দেশাত্মবোধ, নগন্য হবে নগণ্য, নানী হবে নানি, নিচ হবে নীচ (হীন অর্থে), পরিবহন হবে পরিবহণ, পাখী হবে পাখি, পরিস্কার হবে পরিষ্কার, পোষাক হবে পোশাক, পুরষ্কার হবে পুরস্কার, প্রধানতঃ হবে প্রধানত, প্রতিযোগীতা হবে প্রতিযোগিতা, ফলজবৃক্ষ হবে ফলদবৃক্ষ, ফেব্রুয়ারী হবে ফেব্রুয়ারি, বন্দী হবে বন্দি, বিদেশি হবে বিদেশী, বিপদজনক হবে বিপজ্জনক, বিপনী হবে বিপণি, বেশী হবে বেশি, ভবিষ্যত হবে ভবিষ্যৎ, ভালোবাসা হবে ভালবাসা, ভূল হবে ভুল, মহতি হবে মহতী, মুখস্ত হবে মুখস্থ, যতো হবে যত, যন্ত্রনা হবে যন্ত্রণা, রাত্রী হবে রাত্রি, লাইব্রেরী হবে লাইব্রেরি, শৃংখলা হবে শৃঙ্খলা, সৌখিন হবে শৌখিন, শশুর হবে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি হবে শাশুড়ি, সামান্ন হবে সামান্য, হয়ত হবে হয়তো, সহকারি হবে সহকারী, সরকারী হবে সরকারি প্রভৃতি।

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.